শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ২০২০
আফসানা রহমান: সম্পত্তিতে ভাগ পাওয়ার অধিকার নেই হিন্দু নারীদের৷ মুসলিম নারীদের ক্ষেত্রে শরিয়া আইনে তাঁদের ভাগ পুরুষের অর্ধেক, সেটাও ভাগ্যে জোটে না অধিকাংশের৷ এভাবে যুগ যুগ ধরে ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন বাংলাদেশের নারীরা৷সব নাগরিকের সমান অধিকার রক্ষার ধারক সংবিধানের ধারা ২৮ এর অনুচ্ছেদ ১ অনুযায়ী, কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না। এর অর্থ দাঁড়ায়, সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য রাষ্ট্রীয়ভাবে অবৈধ।
সিডও সনদের সংরক্ষিত দুটি ধারা: জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সিডও সনদ বা নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসন সনদ গৃহীত হয়। এই সনদকে বল হয় উওম্যান'স বিল অব র্যাবিটস। এতে ৩০ টি ধারা রয়েছে। ১ থেকে ১৬ নম্বর ধারা পর্যন্ত নারী-পুরুষের সমতা সংক্রান্ত নীতিমালা বর্ণনা করা হয়েছে।
সিডও সনদের ২ ও ১৬ নম্বর ধারা আমাদের দেশে অনুমোদন করা হয়নি। ২ নম্বর ধারায় বলা আছে, নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসনে শরিক দেশগুলো আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবে এবং আইনের সংস্কার করবে। ১৬.১ (গ) ধারায় বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও দায়িত্বের কথা বলা আছে।
এই দুটি ধারা অনুমোদন না করার পেছনে রাষ্ট্রের যুক্তি হলো, এদেশের বেশিরভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে তালাক ও সম্পত্তি বন্টন হয়। সিডও সনদের সম্পূর্ণ অনুমোদন দিলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে। সকল মানুষের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে একরকম নিয়ম আর পারিবারিক ক্ষেত্রে আরেক ধরনের নিয়ম চালু আছে। অর্থাৎ সরকারি নিয়মের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ ধনী বা গরীবে পার্থক্য নেই। যেমন: একজন নারীর গাড়ি কিনতে গেলে ভ্যাট যা দিতে হবে, একজন পুরুষেরও তাই দিতে হবে। তবে পারিবারিক ও উত্তরাধিকার আইন একেক ধর্মে একেকরকম।
আমাদের দেশের অনেক ঘটনাগুলোই ধর্মকে কেন্দ্র করে। যেমন ৪৭ এর দেশভাগ বড় একটি ঘটনা যেখানে ধর্মীয় ব্যাপারটি প্রধান ছিল। ধর্মের কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘুদের ব্যাপারটি সামনে থাকে। সমান অধিকারের কথা আসলে সংখ্যালঘুরা মনে করে, পরিবর্তন হলে আমাদের ধর্ম নষ্ট হতে পারে। আবার সংখ্যায় যারা বেশি তারা মনে করে, তাদের ওপর নেতিবাচক কিছু আসবে কিনা। এমন নানা ভাবনা থেকে অভিন্ন পারিবারিক আইন করা সম্ভব হচ্ছে না।
অনেকেই মনে করেন মেয়েদের সমান সম্পত্তি দিলে তা শরীয়ত মোতাবেক ঠিক হয়না। অথচ বিষয়টি মোটেও ঠিক না। কারণ মুসলিম আইনে বলা আছে, ছেলেরা মেয়েদের অর্ধেক সম্পত্তি পাবে। তবে বাবা চাইলে ছেলে মেয়েকে সমান সম্পত্তি দিতে পারে। ধর্ম ও রাজনীতি দুটো বিষয়ই এক্ষেত্রে জড়িত। আমার মতে এসকল সমস্যার সমাধানের উপায় হলো, প্রতিটি ধর্মীয় আইনে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমানো যেতে পারে।
নারীর বৈষম্য নিরসনের জন্য আনা সিডও সনদের মূল দুটি ধারা অনুমোদন না দেওয়া সমর্থনযোগ্য নয়। আন্তর্জাতিক আইনে সাক্ষর না দেওয়াকে উৎসাহিত করা মোটেও উচিত না। এতে আইনের মূল আবেদনটিই নষ্ট হয়। এক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানবে। আমি মনে করি, সম্পত্তিতে নারীদের সমান অধিকার নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি আছে। মিসর এবং আলজেরিয়া মুসলিম রাষ্ট্র। এই দুটি রাষ্ট্রও সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমান ভাগ দিয়েছে। ধর্মীয় দিক থেকে তাদের কোন সমস্যা হচ্ছে না। শরীয়তের বাইরেও ব্যাপারটি চলে গেল না।
বৃটিশ আমলে হিন্দুদের উত্তরাধিকার একটি আইন ছিল। অবিবাহিত নারী বাবার সম্পত্তির একটি অংশ পাবে। আর বিবাহিত নারীর যদি ছেলে থাকে তাহলে সেই ছেলে সম্পত্তির কিছু অংশ পাবে। স্বাধীনতার পর ভারত এই আইন পরিবর্তন করে। বাবার সম্পত্তিতে ছেলে ও মেয়ের সমান ভাগ এবং স্বামীর সম্পত্তিতেও স্ত্রীর অধিকার আছে। কিন্তু আমাদের দেশে হিন্দু আইন সংস্কার হয়নি। ফলে সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
সম্পত্তিতে ছেলে-মেয়ের সমান অধিকার: সম্পত্তিতে সমান অধিকার না পাওয়া মানেই অর্থনৈতিক দিক থেকে নারীর পিছিয়ে যাওয়া। যেকোন ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাওয়া মানেই সেখান থেকে এগিয়ে যাওয়া কঠিন।
মেয়েরা যতটুকু সম্পত্তি পায় সেটুকুও অনেক সময় নিতে পারে না। ভাবে, সম্পত্তি চাইলে বাবার বাড়ির সাথে তার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে। আরও অনেক কারণে মেয়েরা সম্পত্তি চায় না। এ ধরনের মানসিকতা থেকে মেয়েদের একেবারে বেরিয়ে আসা উচিত বলে আমি মনে করি। ছেলেরা যদি সম্পত্তির অংশীদারিত্ব থেকে পিছিয়ে না যায়, তাহলে মেয়েরা কেন যাবে? মেয়েদের বিয়ের সাথে সম্পত্তির ভাগ ছেড়ে দেওয়া বা আপোষহীন থাকার কোন সুযোগ নাই। নারীকে বুঝতে হবে, এটা তার অধিকার। সে যখন চাইবে তখনই পরিবার তাকে দিতে বাধ্য। এই অধিকার ছেড়ে দেওয়া মোটেও উচিত না।
প্রাপ্য সম্পত্তি ব্যবহারে নারীর পরাধীনতা বিষয়ে অর্পিতা বলেন, মুসলিম ধর্মে নারী তার সম্পত্তি যে কাউকে দিতে পারে। তবে এক তৃতীয়াংশ সম্পত্তি উইল করলে সম্পত্তির অংশীদার আটজনের সাথে কথা বলতে হয়। আর হিন্দু বিধবা নারী জীবনসত্ত্বায় স্বামীর সম্পত্তি ভোগ করতে পারেন। তিনি মারা গেলে এই সম্পত্তির ভাগ পায় ছেলে, ভাতিজা কিংবা ভাইয়েরা। বিধবা স্ত্রী তার জীবদ্দশায় সম্পত্তি বিক্রি করতে পারেন না। তবে তার স্বামীর যদি কোন ঋণ থাকে অথবা তার অন্ত্যষ্টিক্রিয়া বা শ্রাদ্ধ করার জন্য সম্পত্তি বিক্রি করে ঋণ শোধ করার ক্ষমতা রাখে।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে সংবিধানে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সমানাধিকারের কথা বলা হলেও নানা কারণে উত্তরাধিকার আইন নারীর উপযোগী করা হচ্ছে না। অথচ, বাংলাদেশের গত কয়েক দশকের অর্থনৈতিক অগ্রগতির চিত্র বলে নারীরাই উন্নয়নের যাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করে তারা দেশের অর্থনীতি এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখছেন। তাছাড়া দেখা গেছে নারী শিক্ষিত ও সামর্থ্যবান হলে তারা সন্তানের শিক্ষা ও জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন। আর বাবা-মাকে বৃদ্ধ বয়সে ছেলেরা দেখবে বলে যে ধারণা সমাজে প্রচলিত তাও ভ্রান্ত বলেই প্রমাণিত হয়েছে। কারণ, একজন স্বাবলম্বী নারী তার বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিচ্ছেন হাসিমুখেই। তাই ছেলে সন্তানকে বেশি সম্পত্তি দেওয়ার এই যুক্তি আর প্রযোজ্য নয়। নারীর চলার পথ মসৃণ করতে রাষ্ট্র উত্তরাধিকার আইন সংশোধনে উদ্যোগ নেবে বলেই প্রত্যাশা।
লেখক: আফছানা রহমান, বার্তা সম্পাদক সিএনএন বিডি,টিভি।