ইসি এখন বিকলাঙ্গ, গণতন্ত্র আজ মুমূর্ষু। নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যেও বিভাজন। সিইসি বলেন একরকম, উনার কমিশনার বলেন বিপরীত। জনগণের নাগরিক অধিকার স্বাধীনভাবে যাকে খুঁশি তাকে ভোট দেব এটা নিশ্চিত করুন। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের উৎস যে জনগণ, তা সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে স্বীকৃত এবং কোনো না কোনো ভোট বা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তা প্রতিষ্ঠিত। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের মধ্য দিয়েই জনগণ একটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যক্তি হিসেবে নিজের সার্বভৌমত্বকে স্বচ্ছন্দভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়। এভাবে জনগণ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে। তাই রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হলো গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন প্রত্যেক ব্যক্তির ভেতর নিহিত সার্বভৌমত্ববোধের পরিপূর্ণ রাজনৈতিক বিকাশ নিশ্চিত করা। ব্যক্তির এই সামাজিক বিকাশ ও রাজনৈতিক উত্থানকে নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় যে, ব্যক্তি স্বাধীন-সার্বভৌম। জনগণের এই সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার অর্থ হচ্ছে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ব্যক্তিই যে সার্বভৌম, সে যে নিজেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উৎস এবং নিজেই শাসক বা পরিচালক তা সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা।
ব্যক্তিই সার্বভৌম বা ব্যক্তিই সার্বভৌম ক্ষমতার প্রধান উৎস—গণতন্ত্রের এই মর্মবস্তু অবশ্যই শাসনতন্ত্রে বা সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত থাকা প্রয়োজন এবং তার অলঙ্ঘনীয়তাও পরিষ্কারভাবে স্বীকৃত থাকা দরকার। এটা হলো এক প্রতিশ্রুতি যে, প্রত্যেক ব্যক্তির মৌলিক ও সার্বভৌম সত্তা রাষ্ট্র রক্ষা করবে এবং এ ‘রক্ষা’ করার মধ্য দিয়েই রাষ্ট্র নিজের ন্যায্যতা প্রমাণ করবে। ব্যক্তির সার্বভৌম সত্তাকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ না করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও তার পরিচালনার নীতি গড়ে উঠতে পারে না।
বলা হয়ে থাকে যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র ‘জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা’ জাতীয় সংসদের মাধ্যমে প্রয়োগ করে থাকে। দেশের সংবিধানে ‘জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার’ একটি সাধারণ স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে মাত্র। এর অলঙ্ঘনীয়তার কোনো উল্লেখ নেই। বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় পরিচালনার মূল নীতিকেও আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় নাই।
জনগণ রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণ নেয় তাদের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে। কিন্তু গণপ্রতিনিধি নির্বাচনে জনগণের মতের প্রতিফলন ঘটে কি? স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা তাদের কতটুকু? এই ভোটাধিকারের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ কতটুকু আছে, তা পরিষ্কারভাবে বেরিয়ে আসবে বাংলাদেশের সংবিধানের নির্বাচন-সংক্রান্ত বিধানাবলির পর্যালোচনার মাধ্যমে।
বাংলাদেশের সংবিধানের জনগণের ভোটাধিকার ব্যবস্থাপনার জন্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে বলা আছে। এ কমিশন তার ‘সংবিধান প্রদত্ত’ ক্ষমতার বলে দেশে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে, যাতে জনগণ তাদের ভোটাধিকার স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে প্রয়োগ করতে পারে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের গঠন ও ক্ষমতা এবং নির্বাচন-সংক্রান্ত বিধিমালা বলছে, জনগণের জন্য স্বাধীন-নিরপেক্ষভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ যেমন নেই, তেমনি নির্বাচন ব্যবস্থাপনার ওপরে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অবকাশও নেই।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮তে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দান করবেন। সংবিধানের ১১৮(১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬) উপ-অনুচ্ছেদগুলোয় নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ, নিয়ন্ত্রণ ও অপসারণের পদ্ধতি বর্ণিত আছে। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বা তাকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির ওপরে ন্যস্ত থাকায় নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ রয়েছে। কারণ, রাষ্ট্রপতি কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে থাকেন। তা ছাড়া বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ, সুপারিশ, মতামত ছাড়া কোনো ক্ষমতা প্রয়োগে রাষ্ট্রপতি স্বীয় ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকারী নন। ফলে দলীয় আনুগত্য নেই এমন কোনো ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগদানে সুপারিশের প্রশ্ন আসে না। আর প্রধানমন্ত্রী তো সাধারণত তিনিই হন, যিনি দলীয় প্রধান। ফলে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতাও প্রশ্নাতীত নয়।
নিরপেক্ষ নয় এমন নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থাপনায় জনগণের স্বাধীন-নিরপেক্ষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করা একটি অবাস্তব কথা। দেশের বিগত নির্বাচনসমূহে প্রমাণিত হয়েছে যে, নির্বাচনে কারচুপি রোধ, ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা, ভয়ভীতি দেখানো ইত্যাদি প্রতিরোধে নির্বাচন কমিশন সক্ষম হয় না। কারণ, কোনো তাৎক্ষণিক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা কমিশনের নেই। দেখা গেছে, বেশির ভাগ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে। ভোটারদের ভোটাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।
নির্বাচনে কারচুপি হয় এ কারণে যে, কারচুপি করার ফাঁকটি সংবিধানে আছে। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা সরকারের কাছে এত বেশি প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছে যে, সরকার সময়ে সময়ে সংবিধানে নানা সমস্যা সৃষ্টিকারী অনুচ্ছেদ যুক্ত করেছে। এসব বিধি নির্বাচনের বৈধতা-অবৈধতা, কারচুপি বা ভোট দুর্নীতির মতো বিষয়কে বিচার বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে গেছে।
১৯৭২ সালের সংবিধানের ১২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে সচেতনভাবে এসব বিষয়কে বিচার বিভাগের এখতিয়ারের বাইরে রাখা হয়েছিল। নির্বাচনের বৈধতা : এই সংবিধানে যাহা বলা হয়েছে তাহা সত্ত্বেও (ক) এই সংবিধানের ১২৪ অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত বা প্রণীত বলিয়া বিরোধীয় নির্বাচনী এলাকার সীমা নির্ধারণ কিংবা অনুরূপ নির্বাচনী এলাকার জন্য আসন বণ্টন সম্পর্কিত যে কোন আইনের বৈধতা সম্পর্কে কোন আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না; (খ) সংসদ কর্তৃক প্রণীত কোন আইনের দ্বারা বা অধীন বিধান অনুযায়ী কোন কর্তৃপক্ষের নিকট এবং অনুরূপভাবে নির্ধারিত প্রণালীতে নির্বাচনী দরখাস্ত ব্যতীত রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন বা সংসদের কোন নির্বাচন সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।
সংবিধানের এই বিধান এখনো বলবৎ আছে। বর্তমান সংবিধানের ১২৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও (ক) এই সংবিধানের ১২৪ অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত বা প্রণীত বলিয়া বিবেচিত নির্বাচনী এলাকার সীমা নির্ধারণ, কিংবা অনুরূপ নির্বাচনী এলাকার জন্য আসন-বণ্টন সম্পর্কিত যে কোন আইনের বৈধতা সম্পর্কে আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না; (খ) সংসদ কর্তৃক প্রণীত কোন আইনের দ্বারা বা অধীন বিধান-অনুযায়ী কর্তৃপক্ষের নিকট এবং অনুরূপভাবে নির্ধারিত প্রণালীতে নির্বাচনী দরখাস্ত ব্যতীত নির্বাচন বা সংসদের কোন নির্বাচন সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না; (গ) কোন আদালত, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হইয়াছে এইরূপ কোন নির্বাচনের বিষয়ে, নির্বাচন কমিশনকে যুক্তিসংগত নোটিশ ও শুনানির সুযোগ প্রদান না করিয়া, অন্তর্বর্তী বা অন্য কোনরূপে কোন আদেশ বা নির্দেশ প্রদান করিবেন না।
দেখা যাচ্ছে, নির্বাচন-সংক্রান্ত কোনো বিরোধ প্রচলিত আদালতের মাধ্যমে মীমাংসার সুযোগ নাই। সংবিধানে সচেতনভাবে নির্বাচনী আইন এবং নির্বাচনী বৈধতা সম্পর্কে আদালতের এখতিয়ার খর্ব করা হয়েছে। সঙ্গে দেশের নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন (গণপ্রতিনিধিত্ব নির্বাচন অধ্যাদেশ ১৯৭২ পি. ও ১৫৫/৭২) বলবৎ করা হয়েছে এবং সংসদ সদস্য নির্বাচনের বিধিও তৈরি হয়েছে।
সংসদ সদস্যগণের নির্বাচনী বিরোধ সম্পর্কে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১২৫ অনুচ্ছেদের প্রশ্নসমূহ নিষ্পত্তির জন্য এ আইনের ৫৩ ধারা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রয়োজন অনুযায়ী নির্বাচন ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা ও সেই ট্রাইব্যুনালে নির্বাচন বিরোধ এবং এ-সংক্রান্ত সকল প্রশ্ন মীমাংসার বিধান করা হয়। এই বিধান পরবর্তী ক্ষমতাসীন সরকারও নিজ ক্ষমতার স্বার্থে সংশোধন করে। (রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অধ্যাদেশ ১৯৭৮। অধ্যাদেশ ১৪/৭৮)। পরে সকল ক্ষমতাসীন সরকার তাদের প্রয়োজনে এর একাধিক সংশোধন করেছে। এটাকে সাংবিধানিক কর্তৃত্বের ওপরে স্থাপন করেছে। এভাবে সংবিধানে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সংসদীয় সরকার গঠনের নির্দেশনাকে উপেক্ষা করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীর নির্বাচিত হওয়ার বিধান কার্যকর করা হয়েছে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনই এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
প্রতিকারসমূহ হলো :
১) কোনো নির্বাচিত প্রার্থীর নির্বাচন বাতিলকরণ।
২) কোনো নির্বাচিত প্রার্থীর নির্বাচন বাতিল করে দরখাস্তকারী প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ার ঘোষণা দেওয়া।
৩) সম্পূর্ণ নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করা।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী অথবা অন্য কোনো নাগরিক স্বউদ্যোগে নির্বাচনী বিরোধ উত্থাপনের অধিকারী নন। এই অধিকার ব্যক্তিকে তার ভোট রক্ষার অধিকার হিসেবেও প্রদান করা হয়নি। কার্যত এর ফলে প্রত্যেক নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক। যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কখনো করতে পারে না। রাষ্ট্রের এই অধিকার নাই, থাকতে পারে না। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে আছে। তা ছাড়া সংবিধানের ১২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখিত বিরোধসমূহ নিজ উদ্যোগে মীমাংসার জন্য নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালকে কোনো এখতিয়ার দেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশের সংবিধানের এই অগণতান্ত্রিক চরিত্রের কারণে এখানে কখনোই জাতীয় সংসদ কার্যকরী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিকশিত হয় নাই। বাংলাদেশের সংসদ সদস্যরা সংসদে স্বাধীনভাবে যেমন নিজ মত প্রকাশ করতে পারেন না, তেমনি স্বাধীনভাবে কোনো প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দেওয়ার অধিকারও তাঁদের নেই। উপরন্তু প্রধানমন্ত্রীর হাতে সর্বোচ্চ ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকায় সংসদ কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয় না। হতেও পারছে না। এ সুযোগে দেশে গণতন্ত্রের বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্যক্তিতন্ত্র, দলতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র ও লুটপাটতন্ত্র। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সব দলই ক্ষমতাকে স্থায়ী করতে গিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করেছে। এর কারণে দেশে রাজনৈতিক সংঘাত বেড়ে সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্র পরিণত হয়েছে স্বেচ্ছাচারী ও অত্যাচারী ব্যবস্থায়। বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র নিজকে দেশ, জাতি ও জনগণের বিপরীতে দাঁড় করিয়েছে।
সাংবিধানিক পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচনকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা হবে মুশকিল। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো নির্বাচনী সরকার-সংক্রান্ত বিরোধ। সংবিধানের সংশোধন ছাড়া, যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার, দলীয় সরকার অথবা অন্য কোনো সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতেও বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হবে না। ভোটাধিকার নিশ্চিতের শর্ত হলো :
• গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে হলে প্রথমে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এ জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ ও অপসারণ হতে হবে সংসদের অনুমতিক্রমে। এটা নিশ্চিতে সাংসদদের দলনির্ভর ভূমিকা পরিবর্তন করে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকার বিধান চালু করতে হবে।
• সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর একক ও সর্বময় ক্ষমতার বিধান বাতিল করে, ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভাকে সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকার বিধান নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় সংসদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকার এ বিধানটি সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা দরকার।
• নির্বাচন কমিশনের সদস্য নিয়োগের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি খুঁজে বের করতে, একটি সাংবিধানিক অনুসন্ধান কমিটি থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। এ কমিটি যোগ্য ব্যক্তিদের তালিকা সংসদে পেশ করবে এবং সংসদের অনুমোদনের পর রাষ্ট্রপতি কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন।
• নির্বাচন কমিশন একটি স্বতন্ত্র সত্তাবিশিষ্ট সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। জাতীয় বজেটে তার জন্য পৃথক বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। তার নিজস্ব জনবল ও কাঠামো থাকা বাঞ্ছনীয়। এ-সংক্রান্ত বিধিবিধানও থাকা প্রয়োজন।
• জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত সময়ে জাতীয় নিরাপত্তা ব্যতীত বেসামরিক প্রশাসন, সশস্ত্র বাহিনীসহ যাবতীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, অর্থ, তথ্য ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো নির্বাচন কমিশনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতে হবে।
• নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকার ও জবাবদিহির বিধান সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
• নির্বাচন ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তনও আবশ্যক। প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থা ও পদ্ধতির পরিবর্তন করে ফল ঘোষণার নতুন পদ্ধতি বের করতে হবে; ভোটের সমানুপাতিক/সংখ্যানুপাতিক হারে আসন বণ্টনের ব্যবস্থা করতে হবে; ভোটাররা যাতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রত্যাহার করতে পারে সে বিধান রাখতে হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচনী বিরোধ মীমাংসার দায়িত্ব আদালতকে প্রদান করে প্রয়োজনীয় বিধিবিধান প্রণয়ন করতে হবে।
• নির্বাচনে পরিচিত ও চিহ্নিত অপরাধী বা দুর্নীতিবাজ এবং ক্ষমতার অপব্যবহার, জাতীয় সম্পদ পাচার, যুদ্ধাপরাধ, চোরাচালান, মজুদদারি, কালোবাজারি, সরকারি সম্পদ আত্মসাৎকারী ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি সম্পাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করতে হবে।
• নির্বাচন চলাকালীন ও পরে প্রমাণিত অভিযোগের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন যেকোনো নির্বাচন আংশিক বা সম্পূর্ণ স্থগিত ও বাতিল করতে পারবে, এমন সাংবিধানিক বিধান রাখতে হবে।
প্রয়োজনে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে হবে। যার দায়িত্ব হবে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করা এবং সংবিধান সংশোধনের জন্য সংবিধান সভার নির্বাচনের আয়োজন করা।
গণতন্ত্রের বাহন হলো নির্বাচন। নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। কিন্তু নির্বাচনকে এতোই পরিত্যক্ত, অগ্রহণযোগ্য ও হেয় করে ফেলেছে ভোটার গেল কি গেল না সেটি বিবেচ্য নয়।
সারা দুনিয়ার মানুষ আজ কোভিড নামক মহামারিতে আক্রান্ত। আর বাংলাদেশ কোভিডের পাশাপাশি দুর্নীতি, অনাচার, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং দলীয়করণ এ ধরনের আরও কয়েকটা মহামারিতে আক্রান্ত। এতো মহামারি থেকে আল্লাহ যেন দেশটাকে হেফাজত করেন।