মো: ওবায়েদ উল্যাহ ভূলন: শিক্ষাই হলো সর্বোত্তম পদ্ধতি সফলতা অর্জন করার। শিক্ষা হলো মূলত শিখন ও শিক্ষণ প্রক্রিয়ার সুসমন্বিত রূপ।
শিক্ষা তো নানাভাবে অর্জন করা যায়। তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হলো প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিতে শিক্ষা লাভ করার বিষয়টি। আমাদের দেশেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষা অর্জন করার সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়াও রয়েছে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবেও বিদ্যা অর্জনের সুযোগ। যেমন আমরা আমাদের সমাজ, আমাদের পরিবার থেকেই যে জিনিসগুলো আয়ত্ত করি, সেগুলোই মূলত অপ্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের শিক্ষা। তবে এ পদ্ধতিতে শিক্ষা গ্রহণ চালু থাকলেও বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থাকে। কারণ, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার ফলাফল হলো সনদনির্ভর। আর চাকরির বাজারে ‘সোনার হরিণ’ সেই চাকরি খুঁজে পেতে গেলে এই সনদের যে কত মূল্য, তা তো বলা বাহুল্য। অর্থনীতি, কৃষি, স্বাস্থ্য বা অন্যান্য সেবা খাত নিয়ে করোনাকালের নানাবিধ বিপর্যয় ও সংকট উত্তরণে করণীয় নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা ও বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের কথা শোনা গেলেও দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত শিক্ষা নিয়ে তেমন কোন আলোচনা বা পরিকল্পনার কথা সেভাবে কেউ শুনছিনা। সেকারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে আজ অবধি আমার সন্তানের মত দেশের আনুমানিক পৌনে ছয় কোটি বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থী (সংখ্যার বিচারে যা বিশ্বের একশটা দেশের জনসংখ্যার চেয়েও বেশি) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণভাবে দূরে সরে আছে।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে বারবার শুধু সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে আসছে। কেবল ছুটি বৃদ্ধি করার ঘোষণা দিয়েই যেন তাদের দায়িত্ব শেষ। এই পৌনে ছয় কোটি ঘরবন্দি শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ কি, কীভাবে তারা তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নেবে, একটি বছরেরও বেশি শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে চলে যাওয়ায় যাদের চাকরির বয়স পার হয়ে যাচ্ছে - তাদের জন্য কী করণীয় এসব নিয়ে কোন আলোচনা নেই। অথচ এই খাতে যে ভয়াবহ ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে তা কাটিয়ে উঠতে অপেক্ষা করতে হবে বেশ কয়েকটা বছর। এর মধ্যে হারিয়ে যাবে বর্তমান প্রজন্মের একটা বড় অংশ।
করোনা ভাইরাসের এমন অতিমারির সময়েও আমাদের অর্থনীতির চাকা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিদেশ থেকে আশাব্যঞ্জক রেমিট্যান্স এসেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভের পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, গত বছর আমফানসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ বন্যা হওয়া সত্ত্বেও আমাদের কৃষি উঠে দাঁড়িয়েছে, তৈরি পোশাক শিল্প আবার তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে ইত্যাদি। দেশের অর্থ যারা চুরি করে বাইরে পাচার করে তাদের তালিকাও হয়তো প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে, কিন্তু যে সেক্টর দেশে সুশিক্ষিত উৎপাদনশীল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী তৈরি করে, সেই শিক্ষা খাত যে সব কারণে এই করোনাকালে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত সেই কারণগুলো খুঁজে দেখা ও পরিত্রাণের পন্থা নির্ধারণ নিয়ে নীতিনির্ধারণী মহলে কোন আলোচনা নেই কেন?
কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে, কিন্তু বেশিরভাগ অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ এটা আসলে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে নিয়মিতভাবে মাসিক বেতন ও অন্যান্য অতিরিক্ত ফি আদায়ের কৌশল মাত্র। তাছাড়া দেশের অধিকাংশ মানুষ যেখানে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণীভূক্ত এবং বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ও সামর্থ্য নেই এবং সামগ্রিক অর্থে সারাদেশ জুড়ে সে ধরনের অবকাঠামো এখনো তৈরি হয়নি, ফলে এখানেও এক ধরনের বৈষম্যের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। শিক্ষার সাথে সংযুক্ত রাখার স্বার্থে শহরাঞ্চলে অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদেরকে গৃহশিক্ষক রেখে অথবা অনলাইনে একাধিক বিষয়ে কোচিং করাতে বাধ্য হচ্ছেন অনির্দিষ্টকালের জন্য। কিন্তু যাদেরকে এখন টিকে থাকার লড়াই করতে হচ্ছে, তাদের অনেকেই সন্তানের ভাগ্য নিয়তির হাতে ছেড়ে দিয়েছেন!
দীর্ঘকাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত না থাকায় শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার প্রতি মারাত্মক অনীহা তৈরি হচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে গৃহবন্দি থাকার ফলে মানসিকভাবে তারা অসুস্থ হয়ে উঠছে, ইমোশনাল রিঅ্যাকশন দেখাচ্ছে, মেজাজ খিটমিট হচ্ছে, কেউ হয়তো জেদ করে কোন কাজ করা বা খাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে, ইন্টারনেট ও মোবাইলে আসক্তি মারাত্মকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। শারিরীকভাবে চলাফেরা না করার কারণে তাদের ঘুমে প্রচন্ড বিঘ্ন ঘটছে। বেশীরভাগ ছেলেমেয়েরাই রাত জেগে ভিডিও গেমসহ নানা রকমের সোস্যাল মিডিয়ায় ব্যস্ত সময় কাটিয়ে দিনের বেলা ঘুমাচ্ছে। সব মিলিয়ে এক অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম।
করোনাকাল জীবন-জীবিকায়নে মারাত্মক হুমকি হিসাবে দেখা দিয়েছে শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্যও। অথচ বাংলাদেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বেসরকারি খাতে প্রায় পঁয়ত্রিশ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে। কিছু সরকারি এমপিওভুক্ত হলেও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের অর্থ নিজেদেরই জোগাড় করতে হয়। ছাত্র বেতন যেখানে একমাত্র ভরসা।
প্রায় চার লাখ শিক্ষার্থী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করে। বর্তমানে অর্ধেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর অভাবে বন্ধ। তারা সরকার হতে কোনও আর্থিক সহায়তা পায় না। বাকি অর্ধেকের নব্বই ভাগ শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পুরো মাসের বেতন দিতে পারে না। যেগুলো বন্ধ সেগুলোর বেশিরভাগই আর খোলার সম্ভাবনা নেই। একই অবস্থা দেশের অন্যান্য বেসরকারি স্কুল কলেজের ক্ষেত্রেও। ফলে এই পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মচারীদেরকেও সরকারি প্রণোদনা প্রদান এখন অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু কেউ তাদের পাশে নেই!
মধ্যম আয়ের দেশে তালিকাভুক্ত হয়ে যেখানে আমাদের অনেকটা পথ এগিয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে করোনা সুনামিতে লণ্ডভণ্ড আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে সামনের পথ আরও বন্ধুর এবং অনেকটা সময় পাড়ি দিতে হবে। তবে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার বিপর্যয় রোধে বিকল্প ও বাস্তবসম্মত চিন্তা এখনই করতে হবে। শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে সবার আগে। তা না হলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যদি এভাবে অচল হয়ে পড়ে থাকে, তাহলে সুশিক্ষিত জাতি হিসাবে এগিয়ে চলার স্বপ্ন পূরণ অধরাই থেকে যাবে।