শুক্রবার, ০৪ জুন, ২০২১
মো: ওবায়েদ উল্যাহ ভূলন: বাংলাদেশের মানুষের জন্য চরম নিরাপত্তাহীনতা, নিপীড়ন এবং হয়রানির কুখ্যাত অস্ত্র ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’। সাধারণভাবে কোনো আইনের তোয়াক্কা না করে কোনো কারণ না দেখিয়ে বিভিন্নজনকে তুলে নেওয়া, গোপন জায়গায় আটকে রাখা, ক্রসফায়ার, গুম, হেফাজতে নির্যাতন খুন সবই চলছে।
নাগরিক অধিকার হরণের বাস্তবতা এবং ধারাসংক্রান্ত বিবরণী
নিপীড়নমূলক ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’-এর বেশ কয়েকটি ধারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতি, নৈতিকতা এবং মানদণ্ডের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং মানুষকে হয়রানির উদ্দেশ্যে সহজে ব্যবহার করা যায়। এই আইনটি ব্যবহার করে দায়ের করা প্রতিটি মামলা গণমাধ্যমসহ নাগরিকদের চিন্তা, বিবেক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ জীবনের অধিকার ক্ষুণ্ন করতে পারে।এই আইনে ধারা ১৭ (গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোয় বে-আইনি প্রবেশ), ধারা ১৮ (কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার সিস্টেম ইত্যাদিতে বে-আইনি প্রবেশ), ধারা ১৯ (কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম ইত্যাদির ক্ষতিসাধন), ধারা ২০ (কম্পিউটার সোর্স কোড পরিবর্তন সংক্রান্ত অপরাধ), ধারা ৩৩ (বে-আইনিভাবে তথ্য-উপাত্ত ধারণ, স্থানান্তর) এবং ধারা ৩৪ (হ্যাকিং সম্পর্কিত অপরাধ)–এ তিনটি লক্ষণীয় বিষয়:
প্রথমত, এই ধারাগুলোয় জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট হ্যাকিং এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের হ্যাকিংকে পার্থক্য করা হয়নি।
দ্বিতীয়ত, সাইবার ক্রাইম চুক্তিতে এসব অপরাধের অনেকগুলো সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে, যার সব কটি আইনে উল্লেখ করা হয়নি এবং আইনে অনেকগুলো অপরাধের সংকীর্ণ সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে এবং অপরাধের অভিপ্রায় সম্পর্কে পর্যাপ্ত নজর রাখা হয়নি।
তৃতীয়ত, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপরাধসমূহের অনেকগুলোকেই ইতোমধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের বিভিন্ন ধারায় অপরাধী করা হয়েছে। এই আইনের এতগুলো অপরাধকে ভিন্ন ভিন্ন ধারায় ব্যাখ্যা করার ফলে ধারাসমূহ অত্যধিক বিস্তৃত, যা আন্তর্জাতিক সাইবার ক্রাইম চুক্তির বিকশিত মানগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেও করা সম্ভব হয়নি। যার ফলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেকগুলো ধারা সাধারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অপরাধী করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
আইনের অধীন ধারা ৩৫ বলছে: ‘যদি কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ এবং অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করিবার ক্ষেত্রে, মূল অপরাধটির জন্য যে দণ্ড নির্ধারিত রহিয়াছে, কোনো ব্যক্তি সেই দণ্ডেই দণ্ডিত হইবেন।’ এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়:
প্রথমত, যেকোনো আইনে অপরাধে সহায়তা করা এবং প্রত্যক্ষ অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে শাস্তির পার্থক্য থাকে; কিন্তু এই আইনে সেটি করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, ‘অপরাধ সংঘটনে সহায়তা’র সংজ্ঞায়ন করা হয়নি এবং অপরাধে সহায়তার ক্ষেত্রে অভিপ্রায়ের বিষয়টিও নজর দেওয়া হয়নি।
খ. বিস্তৃত অতিরাষ্ট্রিক (extraterritorial) এখতিয়ার প্রয়োগ এবং সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের আশঙ্কা
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪ ধারায় আইনটির অতিরাষ্ট্রিক (extraterritorial) এখতিয়ার প্রয়োগের বিধান জারি করা হয়েছে: ‘যদি কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের বাহিরে এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন যাহা বাংলাদেশে সংঘটন করিলে এই আইনের অধীন দণ্ডযোগ্য হইত, তাহা হইলে এই আইনের বিধানাবলি এইরূপে প্রযোজ্য হইবে যেন উক্ত অপরাধটি তিনি বাংলাদেশেই সংঘটন করিয়াছেন।’ আবার, ৪(২) ধারায় বলা হয়েছে: ‘যদি কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের বাহির হইতে বাংলাদেশে অবস্থিত কোনো কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সাহায্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের বিধানাবলি এইরূপে প্রযোজ্য হইবে যেন উক্ত অপরাধের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া বাংলাদেশেই সংঘটিত হইয়াছে।’ একইসঙ্গে ৪(৩) ধারায় বলা হয়েছে: ‘যদি কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের অভ্যন্তর হইতে বাংলাদেশের বাহিরে এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে এই আইনের বিধানাবলি এইরূপে প্রযোজ্য হইবে যেন উক্ত অপরাধের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া বাংলাদেশেই সংঘটিত হইয়াছে।
বাংলাদেশ খুব কম আইনে অতিরাষ্ট্রিক (extraterritorial) এখতিয়ার প্রয়োগের কথা বলা হয়ে থাকে, তবে আইনের নীতির জায়গা থেকে তা নতুন নয়। কিন্তু ব্যবহারিক দিক থেকে দেখতে গেলে রাষ্ট্রকে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে, বিশেষ করে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের এবং আদালতকে। এসব সমস্যার মধ্যে অন্যতম হলো, যথাযথ আইনি নিয়ম মেনে অন্য আরেকটি রাষ্ট্র থেকে প্রয়োজনীয়, পর্যাপ্ত এবং যথাযথ তথ্য সংক্রান্ত প্রমাণাদি জোগাড় করার ক্ষেত্রে, অতিরাষ্ট্রিক (extraterritorial) প্রয়োগের বিধানটি খুব বেশি মাত্রায় বিস্তৃত, অপরিষ্কার এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের দিকেও পরিচালিত হতে পারে। আমরা মনে করি, দেশের আইনে অতিরাষ্ট্রিক (extraterritorial) এখতিয়ার প্রয়োগের বিধান কেবল তখনই প্রয়োগ করা উচিত, যখন অপরাধটির সঙ্গে সত্যিকারের এবং উল্লেখযোগ্য সংযোগ স্থাপন করা যাবে এবং আদালত ও তদন্তকারী সংস্থাসমূহ পর্যাপ্ত কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে সমর্থ হবে। অতিরাষ্ট্রিক (extraterritorial) এখতিয়ারের অনুশীলনের সবচেয়ে কঠিন দিকটি হলো, এখানে একাধিক রাষ্ট্রের এখতিয়ারের দাবি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি রাষ্ট্র ‘ক’-তে অবস্থানরত রাষ্ট্র ‘খ’-এর নাগরিক, রাষ্ট্র ‘গ’ নাগরিকের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ করে, তবে তিনটি রাষ্ট্রেরই বৈধ ভিত্তি থাকতে পারে। যাতে করে রাষ্ট্রসমূহ নিজ নিজ রাষ্ট্রের আইনি ও এখতিয়ারে নীতি এবং সক্রিয় ব্যক্তিত্বের নীতির ভিত্তিতে অপরাধ এবং অপরাধীর ওপর এখতিয়ার প্রয়োগ করতে ও চাইতে পারেন।এই ধারার কারণে আইনসভা, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মাধ্যমে জাতীয় আইনকে বহিরাগতভাবে প্রয়োগ এবং আন্তঃরাষ্ট্র দ্বন্দ্বের যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক আইন দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে:
১) কখন একটি রাষ্ট্র তার অঞ্চলের বাইরে সংঘটিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, তদন্ত কিংবা নিজ রাষ্ট্রীয় এখতিয়ারে পরিচালনা করতে পারে; এবং ২) দুই বা ততোধিক রাষ্ট্রের মাঝে বিচার বিভাগের অধিক্রমণের সমাধান কেমন হওয়া উচিত? আইনের শাসন হচ্ছে সাংবিধানিক সরকার ব্যবস্থা। যে সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা শুধু অনুমোদিত নয় বরং একটি উত্তম গুণ।
সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সীমিত শাসন ও আইনের শাসনের ধারণাটি দৃঢ়তর। নির্বাহি বিভাগের কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতার অনুপস্থিতি ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারের অঙ্গীকার রয়েছে এখানে। শর্তারোপ করা হয়েছে যে, দেশের সাধারণ আদালতে সাধারণ আইনি প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠিত কোনো আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ব্যতিরেকে কোনো ব্যক্তিকে দন্ড দান করা চলবে না, বা দৈহিক বা বৈষয়িকভাবে কোনো ব্যক্তির ভোগান্তি সৃষ্টি করা যাবে না। ব্যক্তিগত স্বাধীনতা রক্ষার্থে একজন নাগরিক আইনের সুরক্ষার অধিকার রাখে। আইনের শাসনের মূল উপাদান হলো যে, আইন অবশ্যই স্বেচ্ছাচারী বা অযৌক্তিক হবে না। কেননা আইনটি এমন আইন প্রণেতাদের কর্তৃক তৈরি, যারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। Rule of Law - মূলকথা হচ্ছে Every body is equal to the eye of law. মানে সাধারণভাবে এটাকেই বলে আইনের শাসন। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় অন্যতম এ বৈশিষ্ট্যকে বুঝায় শাসক ও শাসিত একই আইনের অধীন।
আমলা কর্তৃক সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের টুটি চেপে ধরে হত্যার চেষ্টা ও ফ্লোরে ফেলে পুলিশ বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রাখার লোমহর্ষক দৃশ্যকে আইনের পরিভাষায় কি বলবেন আমাদের আইন প্রণেতারা? যেখানে কোন আইন প্রণেতার মুখে শুনতে পেলাম না সহমর্মিতার ভাষা। সেখানে আইন বাস্তবায়নকারী আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ আশা করি কিভাবে?
স্বাস্থ্যঅধিদপ্তরের দুর্নীতির চিত্র গণমাধ্যম ফলাও করে প্রকাশ করে আসছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অযোগ্যতা, দায়িত্বহীনতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মন্ত্রীর গদি যায়নি।
বর্তমান সরকারকেই উদারপন্থী রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা সত্ত্বেও এর বিরুদ্ধে তীব্রভাবে গড়ে ওঠা অসন্তোষ, ক্ষোভ-বিক্ষোভের বিষয়টি মাথায় রেখে একে নিয়ন্ত্রণের উপায় খুঁজতে হবে। নাগরিকদের চিন্তা ও ইচ্ছাকে প্রশাসন ব্যবস্থায় সংযুক্ত করতে না পারলে প্রশাসন সচেতন ও সংবেদনশীল হয়ে উঠবে না। আমলারা ক্ষমতার অপব্যবহার অন্যায় কাজ করেই যাবেন।
দফতরগুলোতে জনপ্রতিনিধি হিসাবে মন্ত্রী শাসনবিভাগের প্রধান নির্বাহী। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে যা করা প্রয়োজন তা তিনি স্থির করেন। জনগণের স্বার্থে নজর রেখেই প্রশাসনিক কাজের গতিধারা ঠিক করেন এবং আমলাদেরকে সেভাবে কার্য পরিচালনার নির্দেশ দেন। এই উপায়ে আমলাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা। কিন্তু বাস্তবে কি মন্ত্রীদের এই ক্ষমতা আছে? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?
সরকার প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীদের এক স্থান থেকে অন্যস্থানে রদবদল করে। স্থান বদল হয় কর্ম মানসিকতা তো রয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে এতে সুফল আসেনা বরং প্রশাসনিক ব্যবস্থায় একটি অস্বাভাবিক অসন্তোষ দেখা দেয়। আমলারা আরো দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে পড়ে। উন্নতির বদলে ঘটে অবনতি। যার দায়বহন করতে হয় সরকারকে। বাংলাদেশে একের পর এক সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে। দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক উল্টো মামলা দিয়ে সাংবাদিকদেরই হয়রানি করা হয়৷ একজন নারী সাংবাদিকের সঙ্গে এমন বর্বর আচরণের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখতে চাই।