নির্বাচনের পর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে তিনি চারটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন: এক, যারা দুর্নীতিতে জড়িত, তাদের আত্মশুদ্ধির চর্চা করতে হবে; দুই, আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতিকে উচ্ছেদ করা হবে; তিন, তথ্যপ্রযুক্তির সম্প্রসারণের মাধ্যমে দুর্নীতি নির্মূল করা এবং চার, দুর্নীতি প্রতিরোধে জনগণের অংশগ্রহণ ও গণমাধ্যমের সহায়তার গুরুত্ব দিতে হবে। পরবর্তী সময়ে সেপ্টেম্বর ২০১৯–এ ‘শুদ্ধি অভিযান’ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে শূন্য সহনশীলতার পুনরাবৃত্তি করেন এবং একই সঙ্গে নিজের দলের নেতা-কর্মীসহ কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না মর্মে জোরালো অবস্থান তুলে ধরেন।
তবে শূন্য সহনশীলতার ঘোষণা যতটা সময়োপযোগী ও যৌক্তিক, এর বাস্তবায়ন ততটাই কঠিন ও জটিল, বিশেষ করে এমন পরিবেশে যেখানে রাজনৈতিক এবং শাসনব্যবস্থার সব ক্ষেত্র ও পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দলের একচ্ছত্র প্রভাব প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে; যেখানে যাদের ওপর দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব, তাদেরই একাংশের যোগসাজশেই দুর্নীতি হয় এবং তার সুরক্ষা ঘটে। জবাবদিহি নিশ্চিতের প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিতে ব্যাপক দলীয়করণ ও অবক্ষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ঘোষিত অভিযানের সুফল কতটুকু হবে, তা নিয়ে উদ্বেগ অযৌক্তিক নয়।
অন্যদিকে দুর্নীতি যে বাস্তবেই একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং দুর্নীতি করে বিচারহীনতা উপভোগ করা যায় না, এমন দৃষ্টান্ত স্থাপনে ঘাটতির ফলে চুনোপুঁটি থেকে রুই-কাতলার দুর্নীতির মহোৎসবের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। বালিশ-কেটলি-পর্দা কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে ক্যাসিনো–বাণিজ্যের মতো উৎকট সাগরচুরি ও অবৈধতার তথ্য দেশবাসীকে হতবাক করেছে। আর পর্যবেক্ষকদের কাছে এসব হিমশৈলীর চূড়ামাত্র। ব্যাপক আলোচিত প্রায় প্রতিটি দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের সঙ্গে ছিল ব্যবসা ও রাজনৈতিক পরিচয়ে ক্ষমতাবান ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আর সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের একাংশের যোগসাজশ।
এ দেশে দুর্নীতি করায় গত ৫০ বছরে কয়জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর শাস্তি হয়েছে আমি জানি না। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলায়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ায় বহুজনের জীবন তামা হয়ে গেছে সেটা জানি। কখনো তাদের ওএসডি করা হবে, কখনো বাসায় হামলা হবে, কখনো তাদের পদোন্নতি দেওয়া হবে না, আরও কতো কী যে আছে! নানাভাবে তাদের হেনস্থা করা হবে। বরিশাল সদর উপজেলা ইউএনও মুনিবুর রহমান শোভনের বাসভবনে হামলা হয়েছে।
তবে শুধু শোভন কেন, আমি বহু সৎ কর্মকর্তার করুণ পরিণতি দেখেছি। আপনি যে দপ্তরেই থাকেন ঘুষ খান, কাজ না করেন, কোনো সমস্যা নেই। ওয়াসা-গ্যাস, পাসপোর্ট, ভূমি অফিস আদালত-পুলিশ যেখানেই যান বলেন তো আমাদের সরকারি কোন দপ্তরটায় গেলে সন্তোষজনক সেবা মেলে? দুর্নীতি মানে শুধু আর্থিক দুর্নীতি নয়, যথাসময়ে সেবা না দেওয়া, মানুষকে হয়রানি এগুলোও দুর্নীতি। এসব কারণেও কাক্সিক্ষত সেবা মেলে না। এই যে দুর্নীতি, কাক্সিক্ষত সেবা মেলে না, এসবের বিরুদ্ধে কোনো দপ্তরের সম্মিলিত লড়াই দেখেছেন? বলতে পারবেন এমন কোনো দপ্তরের কথা যেখানে প্রতিষ্ঠান প্রধান থেকে শুরু করে নিচের কর্মচারী সবাই মিলে সেই দপ্তরকে সন্তোষনজনক সেবায় নিতে পেরেছে? পারেনি। গত ৫০ বছরে এই দেশের একটা খাতও দুর্নীতিমুক্ত হয়নি। আর হবেই বা কীভাবে?
কোনো দপ্তরে আপনি যদি কাজ করতে চান, যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তে চান তাহলে আপনার খবর আছে! সহকর্মী থেকে শুরু করে ওপরের কর্তা কিংবা প্রভাবশালী সবার চক্ষুশুল হবেন। রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে আপনার সহকর্মীরা সবাই নানা প্লট সাজাবে। নানাভাবে আপনাকে শায়েস্তা করবে। এসব কারণে সরকারের প্রত্যেকটা বিভাগে, প্রত্যেকটা দপ্তরে তারাই সবচেয়ে বেশি অসহায় যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তে চায়, যারা নতুন কিছু করতে চায়। হ্যা, এটি সত্যি সবার চক্ষুশুল হওয়ার পরেও কিছু মানুষ আজীবন সৎ থাকার লড়াই করে যায়, তারা চেষ্টা করে কিছুটা হলেও সেবা দিতে। আর এটাই আশার কথা। এই মানুষেরা আছে বলেই এখনো দেশটা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায় নাই।
কিন্তু তারা সবার চক্ষুশুল। আর বাকিরা সবাই স্রোতে গা ভাসাচ্ছে। কারণ তাতে কোনো বিপদ নেই। কেউ দায়ী করবে না কেন কাজ করেন না। আর যদি আপনি কাজ করতে চান তাহলে তো খবর আছে। এখন কথা হলো এভাবে আর কতোদিন? আমরা যদি সৎ মানুষদের এগিয়ে না নেই, তাদের যদি সবসময় তটস্থ থাকতে হয়, সব জায়গায় যদি অকর্মন্য আর অসৎরাই রাজত্ব করে তাহলে দেশটা আগাবে কবে? আচ্ছা এভাবে আর কতোদিন চলবে? একটা দেশে দুর্নীতি কম হবে, সুশাসন আসবে, লোকজন কাক্সিক্ষত সেবা পাবে, স্বাধীনতার ৫০ বছরে এই চাওয়াগুলো কী অন্যায়?
সার্বিক বিবেচনায় রাষ্ট্রকাঠামো ক্রমাগতভাবে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের এজেন্ট ও সুবিধাভোগীদের করায়ত্তের মুখোমুখি, যার প্রকট দৃষ্টান্ত ব্যাংক ও আর্থিক খাত। জালিয়াতি ও ঋণখেলাপির কারণে জর্জরিত এ খাতের নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রমের মূল নির্ণায়ক ছিল জালিয়াতি ও ঋণখেলাপির সংস্কৃতির অব্যাহত সুরক্ষা প্রদান, যার বোঝা বইতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে। দুর্নীতি আজ প্রায় সর্বজনীন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। বাদ যায়নি দুর্নীতি দমন কমিশনও, যার উচ্চপর্যায়সহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দৃষ্টান্ত জনগণের হতাশাকে ঘনীভূত করেছে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শুদ্ধাচার সহায়ক ব্যাপক রূপান্তর ব্যতিরেকে দুর্নীতির কার্যকর প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। রাজনীতি ও রাজনৈতিক অবস্থানকে দুর্বৃত্তায়ন ও অবৈধ অর্থের প্রভাবমুক্ত করতে হবে। আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্যের স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও কার্যকর প্রয়োগের স্বার্থে আইন প্রয়োগসংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। সরকারি সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবশালী মহলের প্রভাবমুক্ত করে জনস্বার্থের প্রাধান্য নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতির অভিযোগসহ সব ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতি উৎখাত করতে হবে।
ক্ষমতায় বা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার অর্থ নিজের সম্পদের বিকাশের লাইসেন্স হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের, বিশেষ করে ক্ষমতাবান গডফাদার’দের বিচারহীনতা বন্ধ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী যেমন বলেছেন, আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতি যে–ই করুক, অবস্থান বা পরিচয়নির্বিশেষে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।