আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪ ||
৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শনিবার, ০৯:৩০ অপরাহ্ন
স্বাধীনতা মানে কী?
শনিবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৩
মো: ওবায়েদ উল্যাহ ভূলন: প্রত্যেক জাতীর আশা-আকাঙ্খাক্ষার মূর্ত প্রতীক তার স্বাধীনতা। কারণ, স্বাধীনতা হীনতায় কেউ বাঁচতে চায় না।
স্বাধীনতা একটি শর্ত, যেখানে একটি জাতি, দেশ, বা রাষ্ট্র বা জায়গা যেখানে জনগণ থাকবে, নিজস্ব শাসনব্যবস্থা, এবং সাধারণত কোন অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব থাকবে। স্বাধীনতার বিপরীত হচ্ছে পরাধীনতা. স্বাধীনতা মানে যা খুশি তা করা নয়। কিন্তু যুগ-যুগ ধরে বাঙালি জাতী পরাধীন ছিল। পরাধীন শাসনে বাঙালি জাতী হয়েছে নিষ্পেষিত। বিভিন্ন শ্রেণির শাসকগোষ্ঠী এ বঙ্গীয় নামের জনপদ শাসন-শোষণ করেছে। কিন্তু কারো কাছে মাথা নত করে থাকা বাঙালির স্বভাব নয়। তাই পরাধীন শৃঙ্খল ভাঙতে অতিতে আমাদের বীর সন্তানরা লড়াই করেছে; সংগ্রাম করেছে প্রিয় স্বাধীনতার জন্য। সত্যিই বাঙালি জাতী একাত্তরে মাথা নোয়ায়নি। কারণ, শাসন-শোষণে থাকা বাঙালি জাতীর স্বভাববিরুদ্ধ। ১৬ ডিসেম্বর ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে প্রতিষ্ঠা পায়। স্বাধীনতার মানে-
স্বাধীনতা মানে আত্মমর্যাদা। আত্মমর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকা। সব ধরনের অনাচার, বৈষম্য, শোষণ ও নির্যাতনের বিপরীতে আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, সুষম বণ্টন, অর্থনৈতিক মুক্তি, মানবিক মূল্যবোধ ও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা। এগুলোই আমাদের আত্মমর্যাদা ও একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। একটি স্বাধীন জাতী আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ, পরাধীন জাতীর কখনো আত্মমর্যাদা থাকে না এবং আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতেও পারে না। আমার কাছে স্বাধীনতার মানে হলো, নিজের কাছে যা সঠিক মনে হয় তা বলতে পারা, দুর্নীতি দেখলে প্রতিবাদ করা। আমার কাছে স্বাধীনতার মানে হলো- বাংলাদেশের একটা ভালো খবরে আনন্দে মন ভালো হয়ে যাওয়া, একটা খারাপ খবরে মন খারাপ হয়ে যাওয়া। বাংলাদেশ মানে আমার দেশ। যার সবটুকুই আমার।
পাকিস্তানি আমলেও আমাদের স্বপ্ন ছিল আমরা স্বাধীন হলে আত্মমর্যাদাশীল জাতী হিসেবে বিশ্বের বুকে পরিচিতি অর্জন করব। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কতগুলো লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্যতম ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, যেখানে ধর্মীয় কোনো বিভাজন বা বিদ্বেষ থাকবে না। বাংলাদেশের পরিচয় হবে বহির্বিশ্বে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির। আমাদের লক্ষ্য ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ হবে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত। শোষণমুক্ত সমাজ, ন্যায়বিচার, মানবিক মূল্যবোধ ও সমতাভিত্তিক একটি সমাজ। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা। উল্লেখযোগ্য এ আদর্শগুলোকে সামনে রেখে একাত্তরে এ দেশের মুক্তিপাগল জনতা এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে জয়ী হয়। জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি না এলে স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে স্বাধীনতার ৫২ বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু ৫২ বছরেও বাঙালি মানসিক ভাবে স্বাধীন হয়নি। এই ৫২ বছরে আমাদের অর্জন কি ? নারীদের পথচলা এখনো সুগম হয়নি। ঘরে-বাইরে কোথাও নারীরা নিরাপদ নয়। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ বেড়েই চলেছে। নারী নির্যাতন রোধে দ্রুত আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের কোনো বিকল্প নেই। যে নারী আজ ক্রীড়াঙ্গন, এভারেস্ট জয় করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে উজ্জ্বল করছে, তাদের জীবনের নিরাপত্তা আজ যেকোনো মূল্যে নিশ্চিত করতে হবে। তাদের জীবনের পূর্ণ নিরাপত্তা ও চলার পথ সুগম করতে পারলে দেশের উন্নয়ন দ্রুত ত্বরান্বিত হবে।
স্বাধীনতা বাস্তবায়নে প্রয়োজন অবশ্যই সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন ব্যবস্থা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা।
প্রকৃত অর্থেই বাংলাদেশ একটি অপার সম্ভাবনার দেশ। পৃথিবীর সেরা উর্বর মাটি রয়েছে এ দেশে, যে মাটিতে সোনা ফলে। সুজলা-সুফলা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। তাই যুগে-যুগে হায়েনারা এ কারণেই বাংলাকে তাদের নিজেদের অধিকারে রাখতে চেয়েছিল। আমাদের উর্বর মাটির উপরের অংশে একদিকে সোনা ফলে তথা বিচিত্র ফসলের সমাহার অন্যদিকে মাটির নিচে রয়েছে তেল, গ্যাস, কয়লাসহ নানা ধরনের খনিজসম্পদ। রয়েছে জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তান, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গর্বিত সেনাবাহিনী। উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তবুও কিছু সমস্যা রয়েছে। স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি আমাদের উন্নতির পথে প্রধান শত্রু। সন্ত্রাসী-দুর্বৃত্ত চক্র লুটেরা আমাদের অর্থনীতির গতিকে মন্থর করছে। তাই দুর্নীতিবাজ, লুটেরাদের শৃঙ্খল ভাঙতে হবে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে সমতাভিত্তিক সমাজ। প্রান্তিক চাষি, হতদরিদ্র মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে হবে। কেননা বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হলেও এখনো দরিদ্র মানুষের সংখ্যা রয়েগিয়েছে। এই সংখ্যাকে শূন্যের কোঠায় নামাতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হবে। বাংলাদেশকে প্রকৃত অর্থে একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। একাত্তরে লাখো শহীদের স্বপ্ন একটি উন্নত, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। সেই স্বপ্ন পূরণে আমাদের অবশ্যই দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। কারণ, দুর্নীতিই উন্নতির পথে প্রধান বাধা। তাই রাজনীতিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাজনীতিকে অবশ্যই জনকল্যাণমুখী হতে হবে। তাহলে এ দেশের কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের ভাগ্যের পারিবর্তন ঘটবে। স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারবে ১৮ কোটি মানুষ। তাই আত্মবিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে আমাদের আরও এগোতে হবে।
এ দেশ আমাদের সবার, জাতী, ধর্ম, বর্ণ ও দলমত নির্বিশেষে আমরা সবাই দেশের উন্নয়নের সহযোদ্ধা। দেশকে ভালবাসি এবং শোষণ-দুর্নীতিমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলি।লাখো শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা।‘স্বাধীনতা এটা এমন একটা শব্দ যা অসংখ্য ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিজেকে চিনিয়ে দেয়।
আসলে মানুষের জন্য দরকার নিজের অস্তিত্বকে স্বীকার করা। অস্তিত্ব স্বীকার হলেই মানুষের জীবনে সত্য অর্জিত হয়। কারণ মানুষ সবসময়েই মূলত স্বাধীন। স্বাধীন তাই মানুষকে সাহায্য করে সবকিছুকে চিনতে, ভাবতে ও অর্জন করতে। ব্যক্তি যদি তার অস্তিত্ব বিষয়ে সচেতন থাকে তবে তাকে শোষণ করা সহজ নয়।আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আজও ধারকৃত,গনতন্ত্রের মূল্য নির্বাচনপূর্ব রাতের পঞ্চাশ টাকা, রাজনৈতিক অঙ্গন এখনও পেশী শক্তিনির্ভর , অফিস-আদালত দুর্নীতিগ্রস্ত। স্বাধীন চিন্তা আমাদের এসব এই অরাজকতা হতে মুক্ত করবে, আমাদের মানসিকতা কে স্বাধীন করবে। বাহ্যিক আর মানসিক স্বাধীনতার সম্মিলনে আমরা সেদিন সত্যই স্বাধীন হয়ে উঠব।
বাংলাদেশে এখন যাঁদের বয়স ৫২ অথবা তার কম, তাঁরা জন্মগ্রহণ করেছেন স্বাধীন দেশের নাগরিকের সৌভাগ্য নিয়ে। তার ওপরে যাঁদের বয়স কিন্তু ৭০-এর নিচে, তাঁরা ছিলেন প্রথমে পাকিস্তানের নাগরিক, তারপর স্বাধীন বাংলাদেশের। ৭০-এর বেশি যাঁদের বয়স, তাঁরা জন্মেছিলেন পরাধীন ভারতবর্ষে। তাঁরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করেছেন, তাঁদের সময় আইনের শাসনও ছিল, কোর্ট-কাছারি ছিল, পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছিল লেখাপড়ার জন্য, সরকারি হাসপাতাল ছিল রোগবালাই হলে চিকিৎসা নেওয়ার, রেলগাড়ি-স্টিমার ছিল যাতায়াতের জন্য। কিন্তু তাঁরা স্বশাসিত ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন পরাধীন। তাঁদের শাসক ছিলেন বিদেশি। তাঁরা দেখতে ছিলেন সুন্দর। লম্বা-চওড়া, গোলাপি-ফরসা। তাঁদের ভাষা ছিল ইংরেজি। পাকিস্তানের প্রধান শাসকেরাও উর্দুতে বাতচিত করতেন, বাংলায় নয়। ১৯৭২ থেকে বাঙালি স্বশাসিত। সেটা কম গৌরবের কথা নয়।
৫২ বছর বয়স্করা আজ নিজেদের জিজ্ঞেস করতে পারেন তাঁরা কেমন রাষ্ট্রে বাস করছেন। বাংলাদেশের সংবিধান—দেশের সর্বোচ্চ আইন—যে অঙ্গীকার করেছে, রাষ্ট্রটি সেই রকম কি না? সংবিধান নাগরিকদের যেসব অধিকার দিয়েছে, সেসব অধিকার তাঁরা ভোগ করছেন কি না? সংবিধান যে রকম শাসনব্যবস্থার নির্দেশ দিয়েছে, ঠিক সেই রকম শাসনব্যবস্থায় দেশ পরিচালিত হচ্ছে কি না?
ষোলো বার সংশোধনের পরেও বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান যে অবস্থায় আছে তাতেও বলা হয়েছে: প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে। এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে। [অনুচ্ছেদ-১১]
খুবই স্পষ্ট ঘোষণা। এই দুই বাক্যেই বহু কথা বলা হয়েছে। এই কথা কয়টির অর্থ দাঁড়ায় এই যে রাষ্ট্রযন্ত্র যত ক্ষমতাবানই হোক তার ওপরে একজন ব্যক্তি বা নাগরিকের স্থান। রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো অধিকারই নেই কোনো নাগরিকের ‘মানবসত্তার মর্যাদা’ ক্ষুণ্ন করে—সে নাগরিক যে-ই হোক। হতে পারে সে একজন পকেটমার, ছিঁচকে চোর বা গ্রাম্য বাটপার, অথবা কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মী কিংবা কোনো সংবাদ কর্মী।
সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে পরিষ্কারভাবে বলা আছে: সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। আইনের আশ্রয় লাভ সব নাগরিক যাতে সমানভাবে পেতে পারে তার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এই অধিকারটি আইনের শাসনের প্রাথমিক শর্ত।
সংবিধানের ৩০, ৩১ এবং ৩২ অনুচ্ছেদেও আইনের আশ্রয় লাভের নিরঙ্কুশ অধিকার, জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার রক্ষণ এবং গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির রক্ষাকবচ সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া আছে। এনকাউন্টার, ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ কিংবা গুম সম্পর্কে কোনো অনুমোদনমূলক কথা তো দূরের কথা, ওই শব্দগুলোই সংবিধানে নেই।
মৌলিক অধিকারের অর্থ অবশ্য এই নয় যে একজন নাগরিক যা খুশি তা-ই করবে। মানুষ অপরাধপ্রবণ প্রাণী। ব্যক্তিস্বাধীনতা নাগরিকের একটি মৌলিক অধিকার। সেই সঙ্গে নাগরিককে হতে হবে আইন মান্যকারী ও সুশৃঙ্খল মানুষ। আইনে নিষিদ্ধ কোনো কাজ করলে তার শাস্তি প্রাপ্য। তবে সুবিচারের যে নীতি বা দর্শন তা হলো এমন শাস্তি একজন অপরাধীকে দেওয়া যাবে না, যাতে কারাগার থেকে বেরিয়ে সে আরও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। এবং এমন লঘু দণ্ড দেওয়া যাবে না, যার ফলে বারবার সে একই অপরাধ করার সাহস পায়। একটি সভ্য সমাজে কারাগারে এমন পরিবেশ থাকা বাঞ্ছনীয়, যেখানে গিয়ে অপরাধী আত্মসংশোধনের সুযোগ পায় এবং কারাগারেও যেন তার মানবাধিকার ও মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন না হয়।
সংবিধানে পরিষ্কার ঘোষণা করা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র’। এর ওপরে কোনো কথা নেই। দেশ স্বাধীন হবে কিন্তু সেখানে কোনো গণতন্ত্র থাকবে না—এমন ধারণা নিয়ে কোনো দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীরাই জীবন বাজি রেখে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করেন না। শুধু ভোটাভুটি বা ভোটারবিহীন নির্বাচন মেনে নেওয়াই গণতন্ত্র নয়।
কোনো ধরনের সরকারই একা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারে না। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদা রক্ষার জন্য উচ্চতর আদালতসহ বিভিন্ন সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেগুলো যদি যথাযথ ভূমিকা পালন না করতে পারে তাহলে গণতন্ত্র কার্যকর হয় না। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক, সরকারি কর্মকমিশন, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন প্রভৃতি যে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করছে—সে ব্যাপারে জনগণের সন্দেহ রয়েছে। ওই সব প্রতিষ্ঠান থেকে যদি জনগণ উপকৃত না হয় তাহলে ওগুলোর কোনো দাম থাকে না। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, কেউ হস্তক্ষেপ যদি না–ও করে, কিন্তু দক্ষতা নেই। সাক্ষীগোপালের মতো কিছু থাকা না-থাকা একই কথা। মিডিয়ার ব্যাপকতার কারণে বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানেরা প্রচারমুখী হয়ে পড়েছেন।
দায়িত্বশীল সংবাদমাধ্যম ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। আমাদের সংবাদপত্রের প্রতিবাদী ভূমিকা পালনের ঐতিহ্য আছে। কিন্তু স্বাধীনতার পর বেসামরিক ও সামরিক-আধা সামরিক সরকারগুলো থেকে বিচিত্রভাবে সংবাদমাধ্যম আক্রান্ত হচ্ছে। বস্তুত, ওই আক্রমণ ও চাপ গণতন্ত্রের ওপর।
নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী সংগঠন ও নারী সংগঠনগুলোকে প্রলোভন দিয়ে অথবা ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করিয়ে রাখলে গণতন্ত্রের চরম ক্ষতি হয়। একাত্তরে ছিল ভয়—মৃত্যুর ভয়, নির্যাতনের ভয়, অপমানের ভয়। স্বাধীন দেশে ভয় থাকবে কেন?
লাখো মানুষের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতা কয়েক লাখ মানুষকে এত বেশি দিয়েছে যে তা তাঁদের পূর্বপুরুষেরা স্বপ্নেও দেখেননি। সেটা হতে পেরেছে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দর্শন থেকে শাসকশ্রেণি বিচ্যুত হওয়ায়। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির বাস্তবায়ন ছাড়া সমাজে মানুষে–মানুষে বৈষম্য দূর সম্ভব নয়। অতীতের কোনো গাথাতেই—তা নির্যাতনের কাহিনিই হোক বা বীরত্বের কথাই হোক—বর্তমানের অধিকারহীন মানুষের মন ভিজবে না। স্বাধীনতার সঙ্গে ডিগনিটি অব লাইফ—জীবনের মর্যাদা ও অধিকার জড়িত।
যে দেশে ‘পুত্রহীনা আর বিধবার কাঁদনে’ ‘মর্মের বত্রিশ বাঁধন’ ছিঁড়ে যায়, সেই দেশেরই একশ্রেণির মানুষ আমেরিকা ও মালয়েশিয়ায় বাড়ি করে আর সুইস ব্যাংকে টাকার হাঁড়ি গচ্ছিত রাখে, সে দেশে স্বাধীনতার অর্থ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সবার কাছে সমান অর্থ বহন করে না।স্বাধীনতার মানে খোঁজার চেষ্টায় অনেক হাতড়ে বেড়ালাম। চেষ্টা কতটুকু সফল সে হিসেব না হয় পরেই হলো। আপাতত তা সফলতা আর ব্যর্থতার মধ্যগগণে মেঘের মতো দুলতে থাক। এখন কিছু সর্বজনস্বীকৃত সত্য কথা বলি। স্বাধীনতা ছেলের হাতের মোয়া নয়, যে চাইলাম আর পেয়ে গেলাম। স্বাধীনতার জন্য হুংকার দিতে হয়। দশকের পর দশক জুড়ে পরাধীনতার অনলে পুড়ে যে কষ্ট হয় সেই কষ্টই একদিন কারও মুখে হুংকার জাগায়। সেই হুংকার আটলান্টিকের পানি এক নিমিষে নিঃশেষ করার মতো তীব্র হলেই প্রশান্তরা অশান্ত হয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে। স্বাধীনতা বলতে সেই পরিবেশের সযত্ন সংরক্ষণ বুঝায়, যেখানে মানুষ জীবনের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ খুঁজে পায়। আসলে স্বাধীনতা বিমূর্ত ধারনামাত্র নয়। দৈনন্দিন চর্চায় তাকে পেতে হয়।