সাম্প্রতিক বছরে জনতা ব্যাংকে খেলাপি ঋণ তৈরি হয়নি : আব্দুছ ছালাম
মঙ্গলবার, ০২ মে, ২০২৩
জনতা ব্যাংকের বিদায়ী এমডি ও সিইও মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ
আহসান হাবিব, নিজস্ব প্রতিনিধি: জনতা ব্যাংকের বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ।
জনতা ব্যাংক লিমিটেড বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ব দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক।
জন্মলগ্ন থেকে ব্যাংকটি এদেশের শিল্পখাতের বিকাশে অসামান্য অবদান রাখছে। দেশের অধিকাংশ বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্ম ও উৎপত্তি জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে। দেশের ডলার সংকটের মধ্যেও চলতি অর্থবছরে (জুলাই থেকে মার্চ) ৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে এ ব্যাংকের মাধ্যমে।
২০২০, ২০২১ এবং ২০২২ সালে জনতা ব্যাংকে কোনো খেলাপি ঋণ তৈরি হয়নি। এমনকি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংকটির সঙ্গে জালিয়াতি বা কেলেঙ্কারির কোনো ঘটনা ঘটেনি। আরটিভির প্রতিবেদককে এসব কথা বলেন জনতা ব্যাংকের বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. আবদুছ ছালাম আজাদ।
আগামী ২৯ এপ্রিল শেষ হচ্ছে বর্তমান এমডি আবদুছ ছালাম আজাদের মেয়াদ। আগামী ২৮ ও ২৯ এপ্রিল শুক্র-শনিবার সরকারি ছুটি হওয়ায়, বৃহস্পতিবার তার শেষ কর্মদিবস। ২০১৭ সালে অক্টোবর থেকে তিনি ব্যাংকটির এমডি। বয়স ৬৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় তাকে বিদায় নিতে হচ্ছে।
জনতা ব্যাংকের এমডি হিসেবে যোগদানের সময়টা কেমন ছিল— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যোগদানের পর শুরুর সময়টা বেশি একটা ভালো ছিল না। এ সময় যোগদানের শুরুতে বড় দুটি প্রতিষ্ঠানের (এননটেক্স ও ক্রিসেন্ট) আগে হওয়া ঋণ অনিয়মের ভার আমার ওপরে পড়ে। ২০১৮ সালে এননটেক্স ও ক্রিসেন্টের ঋণগুলো খেলাপি হওয়ায়, খেলাপি ঋণ ৯ হাজার থেকে হুট করে বেড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা হয়। অনেক লোকজন মন্তব্য করেন, ‘আরেকটি সরকারি ব্যাংকের ন্যয় জনতা ব্যাংকও ডুবতে বসেছে।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ও মাশরেক ব্যাংকসহ অন্যান্য বিদেশি ব্যাংকগুলো (যাদের সঙ্গে ক্রেডিট লাইন রয়েছে) জনতা ব্যাংকের এসব ঋণের বিষয়ে বারবার জানতে চেয়েছে। আমরা তাদেরকে আশ্বস্ত করেছি, আপনারা জনতা ব্যাংকের সঙ্গে যে সম্পর্ক রয়েছে তার চেয়ে ভালোভাবে থাকেন, নিশ্চিত প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে দাঁড়াবে। এখন প্রতিটি সূচকেই ২০১৮ সালের পর থেকে বহুগুণ উন্নতি হয়েছে।
আবদুছ ছালাম বলেন, ২০১৮ সালে জনতা ব্যাংকের অপারেটিং প্রফিট মাইনাস ছিল। ২০১৯ সালে অপারেটিং প্রফিট করেছি ৭০০ কোটি টাকা। ২০২২ সালে এসে অপারেটিং প্রফিট হচ্ছে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার বেশি। একইসঙ্গে নিট প্রফিট ২০১৯ সালে ছিল মাত্র ২৪ কোটি টাকা। ২০২১ সালে হয়েছে ৩০০ কোটি, গত বছরে আরও বেড়ে হয়েছে ৩১০ কোটি টাকা।
একইসঙ্গে আমদানি, রপ্তানি এবং আমানত ও ঋণের পরিমাণ ২০১৯-এর তুলনায় ২০২২ সালে ব্যাপক বেড়েছে। ২০১৯ সালে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ৬৯ হাজার ১৪০ কোটি টাকা, ২০২২ সাল শেষে জনতা ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৯ এ ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৪ হাজার কোটি টাকা, ২০২২ সাল শেষে ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫ হাজার কোটি টাকা। ইপিএস (আর্নিং পার শেয়ার) ছিল ২০১৯ সালে ১.৬ টাকা, ২০২২ এ এসে ১৩.৪১ টাকা।
দেশের ডলার সংকটে জনতা ব্যাংকের আমদানির বিষয়ে ব্যাংকটির এই কর্মকর্তা বলেন, ডলার সংকটের মধ্যেও আমাদের ইম্পোর্ট ও এক্সপোর্টের পরিমাণ ভালো। জনতা ব্যাংক এমন একটি ব্যাংক, যার কখনও আমদানি পেমেন্ট ব্যর্থ করেনি। আমরা চলতি অর্থবছরে (জুলাই থেকে মার্চ) মোট ৫ বিলিয়ন ডলার পণ্য ইম্পোর্ট করেছি। এর মধ্যে সরকারি ইম্পোর্ট প্রায় ৪ বিলিয়ন, বাকিটা বেসরকারি আমদানি ছিল। জনতা ব্যাংকের রপ্তানির পরিমাণ অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় বেশি, এই অর্থবছরে প্রায় দুই বিলিয়নের বেশি রপ্তানি হয়েছে।
এ সময় ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ কমাতে তার ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি খুবই সংকটময় মুহূর্তে জনতা ব্যাংকে এসেছি। আমার কাজ ছিল ব্যাংকের বের হওয়া টাকাগুলো যেকোনোভাবে রিকভার করা। ২০১৯-এর পরে খুবই ফ্রেন্ডলি বোর্ড পেয়েছি। ২০১৯-এর আগে আমরা অন্য রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিলাম। জনতা ব্যাংক খেলাপি ঋণের দিক থেকে ১ নম্বরে ছিল। একপর্যায়ে আমাদের খেলাপি ঋণ ছিল ৪৪ শতাংশ।
গত ৪ এপ্রিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের (এমওইউ) মিটিং ছিল, সেখানে আমাদের খেলাপি ঋণ দেখানো হয়েছে ১৭ শতাংশের কিছুটা বেশি। বর্তমানে অন্য সরকারি ব্যাংকের তুলনায় খেলাপি ঋণে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছি। গত ২০২২-এর সেপ্টেম্বরে আমাদের খেলাপি ঋণ ছিল ২০ হাজার কোটি টাকা, এখন আমাদের খেলাপি ঋণ ১৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে আরও কিছু ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়ায় রয়েছি এবং আগামী ২০২৩-এর জুনের মধ্যে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায় হবে; যা পাইপলাইনে রয়েছে।
আবদুছ ছালাম আরও বলেন, এননটেক্স ছাড়াও দুটো বড় গ্রাহক ঋণ রেগুলার করার প্রক্রিয়ায় রয়েছি। জুনের মধ্যে আমাদের খেলাপি ঋণ ১২ হাজার কোটি টাকার মধ্যে চলে আসবে। আমাদের টার্গেট রয়েছে ২০২৪-এর মধ্যে খেলাপি ঋণ সিংগেল ডিজিটে নিয়ে আসা। আর আগামী ২০২৫-এর মধ্যে জনতা ব্যাংককে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর মধ্যে সেরা ব্যাংক হিসেবে দেখতে চাই। সেবাগত মান, স্মার্টনেস, ব্যাংক আধুনিকায়ন, অনলাইন কোর ব্যাংকিং সল্যুশন (সিবিএস) বাস্তবায়ন হয়েছে। আমরা ই-জনতা চালু করেছি। যেখানে ঘরে বসে গ্রাহকরা সকল ধরনের লেনদেনের সুযোগ পাবে।
এননটেক্সের পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ পুরোপুরি রিকভারি হয়ে গেলে, এ ছাড়া আরও বড় কিছু গ্রাহকের ঋণগুলো আদায় করতে পারলে ২০২৫-এর মধ্যে জনতা ব্যাংক সেরা ব্যাংক হিসেবে অবস্থান করবে।
বর্তমানের বৈশ্বিক সংকটে ব্যাংকিং সেক্টরের চ্যালেঞ্জের বিষয়ে এমডি বলেন, কোভিডের পরে ২০২২-এর ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হলো রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ। যে কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম ব্যাপক বৃদ্ধি ও সাপ্লাই চেইন ডিজরাপশন হয়েছে। একইসঙ্গে বিভিন্ন দেশের কারেন্সির ন্যায় দেশের টাকার তুলনায় ডলারের দাম অনেক বেড়ে গেছে, এতে তৈরি হয়েছে ডলার সংকট। অনেক উন্নত দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি যেখানে ১৩ শতাংশের বেশি, সে সময়ে আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতি এখনও সাড়ে ৮ শতাংশ। অনেকে মনে করেছে রমজানে তেল, খেজুর, ছোলা পাবে না, কিন্তু আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বাজারে স্বাভাবিক রয়েছে।
২০২২-এর জুলাইতে দেশের ডলার বাজারে যে সংকটটা দেখেছি, এখন অনেকটা কমে এসেছে। এখনও আমাদের রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলার রয়েছে। মার্চে রেমিট্যান্স এসেছে দুই বিলিয়নের বেশি, আগামী কয়েক মাসও বেশি আসবে কারণ একটা ঈদ সামনে রয়েছে। এখনও আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ভালো রয়েছে, আমরা ঋণের টাকাগুলো ফিরে পাচ্ছি।