” মা’য়ের শেষ কথা ফেলা দায়। কিশোর জিন্নার মন গলে পড়লো। মায়ের ইচ্ছাপূরণ করে দূরসম্পর্কের চাচাতো বোন ইমিবাইকে বিয়ে করে। ঘোমটাপড়া নবপরিণীতার বাঁধাভাঙ্গা অনুভূতির মধুররুদ্ধশ্বাস সঙ্গে করে লন্ডনের উদ্দেশ্যে ছুটলেন ব্যারিস্টারি পড়ুয়া জিন্না। মায়ের বাধ্য ছেলের কিন্তু কপালে সুখ সইলো না। প্রিয়তমাবধু ইমিবাইকে তিন মাসের ব্যবধানে বরণ করতে হলো মৃত্যুকে। এ শোকের পাহাড় ঠেলে চলতেই ধরা দিলো, আরও একটা শোক, মমতাময়ী ‘মা’ যে আর নেই। এ মৃত্যুর খবর পেলেন লন্ডনে বসেই। মাত্র ১৯ বয়সে শোক স্মৃতি হয়ে থাকলো। ১৮৭৬ সালে জন্ম নেয়া জিন্না আর বিয়ের নাম নিলেন না। ১৯১৬ মুসলিম লীগের সভাপতি হলেন। দুই বছর বাদে প্রেমে জড়ালেন তাঁর চেয়ে ২৪ বছরের ছোট তরুণী রুক্তিকে। পুরো নাম রতনবাই পেট্টি রুত্তি। ঘনিষ্ঠ বন্ধু বোম্বাইয়ের যশস্বী পারসি স্যার দিনশো পেট্টির যুবতী কন্যা রুক্তি। তাঁকে কি করে বিয়ে? মনের লেনদেন ধর্মবিশ্বাস রুখতে পারলো না। প্রেমেরপ্রীতি বিয়েতে পরিনত করলো। বয়স এবং ধর্মে অসম এ বিয়ে দুই পরিবারের বাইরেও তুমুল ঝড় তুললো। সমালোচনার পাত্র হলেন জিন্না। গোঁড়া মুসলিম নেতারাও বিয়েকে দেখলেন আড় চোখে । রতনবাই রুক্তি ইসলাম ধর্মগ্রহণে বাধ্য হলেন জিন্নাহর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ভেবে। হারাতে হলো তার জন্মদাতা মা-বাবা,ভাই-বোন গৌষ্ঠিকূল। রতনবাই পেট্টি রুক্তি ‘মরিয়ম জিন্নাহ’ কলেমা পড়ে কবুল হলেন। ১৯১৯ সালে মরিয়মের গর্ভে জন্ম নিলো একটি কন্যাসন্তান। কন্যার নাম রাখলেন জিন্নাহ সখ করে নিজেই, ‘দিনা জিন্নাহ’ । কিছুদিন পরেই উচ্চবিলাসী মরিয়মের সঙ্গে বাঁধলো মনস্তাত্ত্বিক লড়াই। ছন্দ হারালো তাঁদের দাম্পত্য জীবন। কলোহ- ভোগান্তির কারণ হয়ে উঠলো। জিন্নাহ পতœী রতনবাইকে নিয়ে ইউরোপ ভ্রমন করলেন শান্তির অন্বেষণে। তবে বিফল হল,১৯২৭ সালে পরস্পরের মধ্যে বিগ্রহ বিদ্বেষ বিচ্ছেদে গড়ালো। দুই বছরের মাথায় তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর মৃত্যুর খবর শুনে ভেঙ্গে পড়লেন জিন্নাহ। পরবর্তী জীবনে পুরোটাই তাঁর বোন ফাতিমা আগলে রাখেন পরম যতেœ-সমাদরে। যাতে, ভাইয়ের মনে আশার সঞ্চার সৃষ্টি এমন এক বোনের ভুমিকায় অবতীর্ণ হলেন ফাতিমা যা ভাই-বোনের সম্পর্কে বিস্ময়কর এবং বিরল। তাঁর দেখভাল শুধু নয়, ভাইয়ের কন্যা দীনা ফাতিমার স্নেহালয়ে লালিত হলেন। তরুণী হতেই পারস্য বংশোদ্ভূত খ্রিষ্টান ব্যবসায়ী নেভিল ওয়াদিয়াকে বিয়ে করে আশার প্রদীপ নিভিয়ে দিলেন। জিন্নাহ কন্যাকে ত্যাগ করেন। ক্লান্তিকর ও অসহনীয় অবস্থা তাঁকে নিস্তার দেয়নি জীবনের শেষ দিনটিতেও। মৃত্যুর শয্যায় কাতর জিন্নাহ এক বছর আগে সারা ভারতে কাঁপন তুলেছেন। দ্বিজাতিতত্ত্বে পাকিস্তানের অভ্যুদয় ঘটিয়ে জাতির পিতার আসনে সমাসীন। রাষ্ট্রের সবকিছু তাঁর অঙ্গুলি নির্দেশ করে চলে সেই জিন্নাহ হাসপাতালের বেডে শেষ কটা দিন ছিলেন চরম অবহেলায়। জেনে গেছে সবাই যক্ষ্মা তাঁকে গ্রাস করেছে। সেকালে প্রবাদ হয়ে উঠছিল, ‘ যার হয় যক্ষ্মা তার নাই রক্ষা।’ রাজনীতি সরকার সব জিন্নাহ কব্জাছাড়া। নবাবজাদা ভুলিয়ে রাখে। জিন্নাহ লন্ডনে চলে গিয়ে আর ফিরছেন না এমন একটা পরিস্থিতি বিরাজমান যখন তখন আগা খান, স্যার ইকবাল, চৌধুরী রহমত আলী বুঝিয়ে সুঝিয়ে ১৯৩৪ সালে ফিরিয়ে আনেন। ১৯৩০ সালে স্যার আল্লামা ইকবাল উত্তর পশ্চিমে ভারতে মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি করলে ১৯৩৩ সালে সেই রাষ্ট্রটির নাম দেন “পাকিস্তান ” জিন্নাহ পরবর্তী কালে দ্বি জাতি তত্ত্ব। ১৯৪৩ সালে উগ্রবাদী কাকসারস তাঁকে হত্যা করতে হামলা করলেও বিস্ময়কর ভাবে বেঁচে যান জিন্নাহ । ১৯৪০ সালে যক্ষ্মা রোগ আক্রমন করলেও বোন ছাড়া কাউকে আঁচ করতে দেননি। অমানবীয় পরিশ্রম ও পারিবারিক পরিনতি জিন্নাহ ভেঙ্গে পড়েন মানসিক দিক দিয়েও। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর স্বাধীনতা লাভের এক বছরের মাথায় ফুসফুসে ক্যান্সারে ৭১ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করলে করাচীতে রাজকীয় মর্যাদায় সমাহিত হন এ জনক। সমাধিস্থল মাজার-ই কায়েদ নামে পরিচিত। জিন্নাহ শেষকালে অছিয়ত করেন তাঁর নামাজে জানাজা যেন আল্লামা আহমদ ওসমানী পড়ান।
১৯২০ সালে স্থায়ীভাবে কংগ্রেস ছেড়ে দিলেন। সর্বকনিষ্ঠ ইন্ডিয়ান হিসাবে বার-এট-ল অব ইংল্যান্ড -এ ভূষিত হলেন। দাদাভাই নওরোজী ও ফিরোজশাই মেহতার সান্নিধ্য লাভ করে রাজনীতির প্রতিও অনুরক্ত হন। বোম্বাই – এ স্বল্প সময়ের মধ্যে যশস্বী হয়ে ওঠেন। কংগ্রেস নেতা বাল গঙ্গাধর তিলকের মামলা পরিচালনা করে নজর কাড়েন সবার। ১৮৯৬ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগে তাঁকে যোগদানের অনুরোধ করলেও যোগদেন ১৯১৩ সালে। ১৯১৬ সালে লখনৌ কাউন্সিলে সভাপতি হন। ১৯১৬ সালে আবার হোমরুল লীগ প্রতিষ্ঠা করেন।ওঁরা মানে পাকিস্তানিরা ওঁদের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকেও শান্তিতে মরতে দেয়নি। স্কুলের রেকর্ডে তাঁর জন্ম ১৮৭৫, ২০ অক্টোবর হলেও পরবর্তী সরকারি নথিপত্রে ২৫ডিসেম্বর ১৮৭৬ উল্লেখ রয়েছে। মোহাম্মেদালী জিন্নাবাই পিতা জিন্নাবাই পুনজা ও মা মিথিবাই এর জ্যেষ্ঠ সন্তান তাঁর বাল্য নামেও পরিবর্তন করে হয়ে ওঠেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তাঁর পিতা একজন ধনী গুজরাটি বণিক ছিলেন। পিতামহ পুনজা মেঘজি কাথিয়ারের গোন্ডল রাজ্যের প্যানলি গ্রামের একজন ভাটিয়া ছিলেন। মুলতানের নিকট সাইওয়ালে বসতি গড়েন। জিন্নাহর পূর্বপুরুষ পাঞ্জাবের অন্তর্গত সাইওয়ালের হিন্দু রাজপুত থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। আহমদ,বন্দে, রহমত এবং বোন মরিয়ম,ফাতিমা ওশিরিন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভাই বোন। মার্তৃভাষা গুজরাটি হলেও তাঁদের পরিবার কুচি,সিন্ধি, উর্দু ও ইংরেজী ভাষা রপ্ত করেন। অর্থবিত্তেও সমৃদ্ধ করাচির সিন্ধ মাদ্রাসাতুল ইসলাম, বোম্বাইয়ের গোকলদাশ তেজ প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১৬ বছর বয়সে করাচির ক্রিস্টান মিশনারি সোসাইটি উচ্চবিদ্যালয় এবং পরে বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন ডিগ্রী অর্জন করেন।
লেখক: সোহেল সানি সাংবাদিক ও কলমিষ্ট, উপদেষ্টা সম্পাদক সিএনএন বিডি .টিভি।