ডিজিটাল কারচুপির অভিযোগ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা: প্রমাণ করার সুযোগ এসেছে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের!
সোমবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০২০
আফসানা রহমান: ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে দুই ‘নগরনেতা’ ভোটারেরা নির্বাচন করবেন ১ ফেব্রুয়ারি । নির্বাচন হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)।
ইভিএমকে বলা হচ্ছে ডিজিটাল ভোটাধিকার প্রয়োগের যন্ত্র, যদিও এ নিয়ে বিতর্ক আছে। একপক্ষ এই ইভিএমকে নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে। ইভিএম নিয়ে আরেক পক্ষের আপত্তি নাই। বিরোধী পক্ষের শঙ্কা ইভিএমে ডিজিটাল কারচুপির, যদিও এই ইভিএম পদ্ধতিতে জাল ভোট দেওয়ার সুযোগ নাই বলে বারবার দাবি করে আসছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসির আরও দাবি ইভিএম ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া সম্ভব না বলে এই মেশিন হ্যাক করা যাবে না, ফলে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ভোটের ফল পালটে ফেলার সুযোগ এখানে নাই।
বাংলাদেশের স্থানীয় নির্বাচনসহ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কিছু সংখ্যক আসন-কেন্দ্রে ইভিএম পদ্ধতির প্রয়োগ ইতোমধ্যেই হয়েছে। এই পদ্ধতিতে হ্যাক করে ফল পালটে দেওয়ার মত অভিযোগ আসেনি। ইভিএমে একজনের ভোট আরেকজন দিয়ে দিয়েছে, এমন অভিযোগ প্রমাণের মত কিছু পাওয়া যায়নি। তবে বড় পরিসরে এর প্রয়োগও হয়নি অদ্যাবধি। তবু এই পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি সরকারবিরোধী দলগুলোর, বিশেষত বিএনপির। এই আপত্তির কারণ মূলত নির্বাচন কমিশনের প্রতি তাদের আস্থাহীনতা। কারণ ইভিএমের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইসি এখনও কিংবা কখনই রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করতে পারেনি।
ইসির বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ পক্ষপাতিত্বের। স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইসি এখনও কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেনি। একাদশ সংসদ নির্বাচনেও ইসির ভূমিকা ছিল হতাশাজনক। তারা সকল দলের জন্যে সমান সুযোগ তৈরি করে দিতে পারেনি। এই সিটি নির্বাচনেও সেই নিশ্চয়তাও দিতে পারেনি। ফলে ইসির যেকোনো সিদ্ধান্তকে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো প্রথমে সন্দেহের চোখে দেখে।
ইসি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান । ইসির নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানের তকমা কেবল কাগজেকলমেই, বাস্তবে হয়নি। এর দায় আছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) থেকে শুরু করে নির্বাচন কমিশনারসহ ইসি সচিব এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। রাষ্ট্রের অধীনস্থ কর্মচারী হিসেবে ইসির অনেককেই নিজেদের উপস্থাপনের চাইতে সরকারের অনুগত কর্মচারী হিসেবে নিজেদের প্রমাণে অনেক সময় মরিয়াভাব দেখা যায়।
নির্বাচন কমিশন-ইভিএমএকাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্বাচন নিয়ে ইসির বিরুদ্ধে যেসকল অভিযোগ ওঠেছিল সেগুলোকে প্রথম দিকে অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে ইসির শীর্ষ ব্যক্তিত্বদের নানা বক্তব্যে সেই অভিযোগগুলোকে প্রায় কবুল করা হয়েছে। ইভিএমের পক্ষে বক্তব্য দিতে গিয়ে খোদ সিইসি বলছেন, ইভিএমে ভোট হলে রাতের ভোট বন্ধ হয়ে যাবে।‘এই ‘রাতের ভোট’ বিষয়টি বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল। সিইসি ইভিএমে নির্বাচনের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে গিয়ে বিগত নির্বাচনের বড় অভিযোগকেই স্বীকার করে নিয়েছেন।
সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তি সত্ত্বেও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ইভিএমে ভোট হচ্ছে নিশ্চিত। বিএনপি যতই আপত্তি করুক তাদেরকে এই পদ্ধতিতে নির্বাচনে আসতে হবে। এই দুই সিটিতে যদি ইভিএমে ভোট হয় তবে সেটা হবে বড় পরিসরে ইভিএমে নেওয়া প্রথম ভোট।
ইভিএমে হ্যাকিং করে নির্বাচনের ফল পালটে দেওয়া যাবে না- নির্বাচন কমিশনের এই দাবি প্রমাণের ক্ষেত্র হচ্ছে ঢাকার এই ভোট। একজনের ভোট আরেকজন দেওয়া সম্ভব কি না, কিংবা ইভিএম দিয়ে রাতের আঁধারে আগে থেকে ভোট দেওয়া সম্ভব কিনা- এসবেরও প্রমাণ হবে এই নির্বাচনে। ফলে ইভিএম পদ্ধতি বড় ধরনের পরীক্ষার মুখে পড়তে যাচ্ছে এই নির্বাচনে। এই নির্বাচনে মানুষ যদি নিজেদের ভোট দিতে পারে, যদি এখানে কারচুপির পথ বন্ধ হয়ে যায় তবে এই পদ্ধতি আগামীতে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে পারে।
আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার যে স্লোগান দিয়েছিল নির্বাচন ব্যবস্থায় তার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের পথে এই নির্বাচন একটা মাইলফলক হতে পারে। ইভিএম প্রচলিত নির্বাচন পদ্ধতির বাইরে ডিজিটাল পদ্ধতি। এই পদ্ধতিকে ‘ডিজিটাল কারচুপি’ বলে আসছে বিএনপিসহ সরকারবিরোধি দলগুলো। এই অভিযোগ যে ভিত্তিহীন ও মিথ্যা তা প্রমাণ করার সুযোগ এসেছে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের সামনে।
ইভিএমে সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ একদিকে যেমন প্রযুক্তির ব্যবহারে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পথে আমাদের এগিয়ে যাওয়া হবে, অন্যদিকে এর মাধ্যমে কাগজের ব্যবহারও কমে যাবে। কারণ এই পদ্ধতিতে ভোট নেওয়ার মাধ্যমে ব্যালট পেপার মুদ্রণের প্রয়োজন পড়বে না। এই ভোটিং সিস্টেম আমাদের পরিবেশের জন্যেও সহায়ক হবে।
আমরাও মুখিয়ে আছি বড় পরিসরে এই পদ্ধতির প্রয়োগ ও এর ফল দেখতে। এখানে ইসি যদি সফল হয়, এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ সকল নির্বাচনে এর প্রয়োগ করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারাদেশে এর ব্যবহার হতে পারে। এটা তাই বড়ধরনের পরীক্ষা ক্ষেত্র। এখানে তাদের ব্যর্থ হওয়া যাবে না। এখানে তারা ব্যর্থ হলে ইভিএম পদ্ধতিই ব্যর্থ হয়ে যাবে।
যন্ত্র মানুষ তৈরি করে। যন্ত্রকে যন্ত্রের মত কাজ করতে দেওয়া না দেওয়াও নির্ভর করে সেই মানুষের হাতেই। এখানে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে। তা না হলে সব প্রচেষ্টাই বৃথা হয়ে যাবে।