আমি ব্যর্থ,বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে পারিনি : কে এম সফিউল্লাহ
শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২০
আহসান হাবিব, নিজস্ব প্রতিনিধি: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ হাতে আমাকে সেনাপ্রধান বানিয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর মধ্য থেকেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে।
আমাকে অন্ধকারে রেখে আমার সৈন্যদেরই একটি অংশ ষড়যন্ত্র করেছে। বঙ্গবন্ধু আমার কাছে সহায়তা চেয়েছিলেন। কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। আমার সে সময় সামর্থ ছিল না। কী করতে পারতাম। ওই সময়ে কিছু করার মতো আমাদের পজিশন ছিল না। আমি সেদিন বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে পারিনি। প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারিনি। আমার নির্দেশ অমান্য করেছে। কর্নেল শাফায়াত জামিল আমার নির্দেশ মানেনি।
অন্যদিকে খুনিরা অস্ত্রের মুখে আমাকে খন্দকার মোশতাকের কাছে নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে আমি নিজেকে ব্যর্থ মনে করি। একজন মুক্তিযোদ্ধা যে কিনা একাত্তরের ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে পাকিস্তানিদের সামনেই বিদ্রোহ করে বেরিয়ে এসে দেশের জন্য অস্ত্র তুলে যুদ্ধ করেছি, আর সেই আমিই নিরুপায় হয়ে খুনিদের সামনে চুপ থেকেছি। এই কষ্ট আমাকে কুঁরে কুঁরে খায় বললেন সাবেক সেনাপ্রধান, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ’৭১-এর সভাপতি কে এম সফিউল্লাহ। জাতির পিতা হত্যাকাণ্ড, নিজের অবস্থান, খুনিচক্র নিয়ে কথা বলেন তিনি।
১৯৭৩ সালের অক্টোবরে কে এম সফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান ও জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান করা হয়েছিল। জিয়াউর রহমানকে উপপ্রধান করাটা ঠিক হয়নি বলে মনে করেন কে এম সফিউল্লাহ। তিনি বলেন, আমাকে সেনাপ্রধান ও জিয়াকে উপপ্রধান করে বঙ্গবন্ধু মস্ত বড় ভুল করেছিলেন। আমরা একই ব্যাচের হলেও জিয়াউর রহমান আমার চেয়ে ১ নম্বরের সিনিয়র ছিলেন। সেজন্য আমি কিন্তু সেনাপ্রধান হতে চাইনি। জেনারেল ওসমানী ৫ এপ্রিল ডেকে বললেন, তুমি আর্মি টেক ওভার করো। আমি বললাম, আমার সিনিয়র আছে। আমার ৩ জন সিনিয়রের নাম বললাম। কর্নেল রব, সি আর দত্ত ও জিয়াউর রহমান। তখন আমি বললাম, এটা ঠিক হবে না। আমি বললাম, স্যার, এ সময়ে কী কাজটা করা ঠিক হবে? আমাদের মধ্যে তো একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হবে। অফিসিয়াল সিদ্ধান্ত হোক আর যাহোক, এটা ঠিক হচ্ছে না। এরপর বঙ্গবন্ধু আমার সঙ্গে ৬ ঘণ্টা কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু বুঝিয়ে বললেন, বড় বড় ইংরেজি না বলে কাজ কর। নতুন দেশের নতুন সেনাবাহিনী। গুছাতে হবে। আর আমি সবাইকে দায়িত্ব দিতে চাই না।
জিয়াউর রহমান জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় জড়িত ছিল এমন মন্তব্য করে কে এম সফিউল্লাহ বলেন, জিয়ার কাছ থেকেই ডালিম পারমিশন নিয়েছে। তবে খালেদ মোশাররফ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা জানতেন না, এটা আমার বিশ্বাস। হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে তিনি উদ্ভ্রান্তের মতো আমার কাছে চলে এসেছেন। অন্যদিকে মেজর জিয়া ক্লিন সেভ করে একেবারে তৈরি হয়ে এসেছেন। আর কর্নেল শাফায়াত জামিলকে আমি নির্দেশ দিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে ফোর্স পাঠাতে। সে কি করে বলে আমি ফোর্স পাঠাইনি? তাহলে তাকে ফোন করেছিলাম কেন? সে বললো, রশিদ বলেছে শেখ মুজিবকে তারা মেরে ফেলেছে। রশিদ তো তার ব্রিগেডের আন্ডারেই ছিল। তাহলে আমি কি ধরে নিতে পারি না শাফায়াত জামিল জানতো? সে আমার নির্দেশ অমান্য করেছে।
সাবেক এই সেনাপ্রধান বলেন, বেতার দখল করার পর মেজর ডালিম ১৫/১৬ জন সোলজার নিয়ে আমার দিকে অস্ত্র তাক করে। ডালিমকে বললাম, এই অস্ত্র দেখে এবং ব্যবহার করে আমি অভ্যস্ত। তুমি যদি এর ব্যবহার করতে চাও, করে যাও। আমি বাধা দেব না। আর যদি কথা বলতে এসে থাক, তাহলে অস্ত্র রাখো এবং তোমার লোকদের বাইরে যেতে বলো। ডালিম জানায়, প্রেসিডেন্ট আমাকে যেতে বলেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কে প্রেসিডেন্ট? সে খন্দকার মোশতাকের নাম বললে আমি পাল্টা জবাব দেই, মোশতাক তোমার প্রেসিডেন্ট, আমার নয়। ওরা আমাকে অস্ত্রের মুখে নিয়ে যায়। পরে জীবন বাঁচাতে তাদের রাষ্ট্রদূত হওয়ার অফার নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাই। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কমিশন হওয়া প্রয়োজন মন্তব্য করে কে এম সফিউল্লাহ বলেন, জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডের সার্বিক দিক উন্মোচনের জন্য অবশ্যই তদন্ত কমিশন হওয়া উচিত। তাহলে কে কী ষড়যন্ত্র করেছেন সব বেরিয়ে আসবে। জাতির অবশ্যই সব সত্যি জানা প্রয়োজন।