রহিম রেজা, ঝালকাঠি: ঝালকাঠির কাঠালিয়ায় সদর ইউনিয়নের বিষখালী নদীতে এক যুগেরও আগে ৭০ একর জমি নিয়ে নদীর বুকে জেগে উঠে এক বিশাল চর। যেখানে রয়েছে লক্ষাধিক ছৈলা গাছ।
আর ছৈলা গাছের নাম থেকেই জেগে ওঠা এ চরের নামকরণ করা হয়েছে 'ছৈলার চর'। ছৈলা ছাড়াও এখানে কেয়া, হোগল, রানা, এলি, মাদার, আরগুজিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছে ঘেরা। ছৈলা গাছের ডালে ডালে শালিক, ডাহুক আর বকের ঝাঁক। গাছে গাছে রয়েছে মৌমাছির বাসা ও মৌচাক। তাই পাখির কিচিরমিচির ডাক ও মৌমাছির গুন গুন শব্দ সব সময় শোনা যায়। শীতের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে অভয়াশ্রম হিসেবে আশ্রয় নিতে আসতে শুরু করেছে অতিথি পাখিও। ভ্রমণ পিপাসুদের প্রতিদিনের পদচারণায় এখন মুখরিত ছৈলার চর। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছে চরটি। এখানে পা রাখতেই কানে বাজবে শোঁ শোঁ শব্দ। মূলত বাতাসে ছৈলাপাতার নাচনে এমন শব্দ তৈরি হয়। মাঝেমধ্যে গর্জন করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে নদীর ঢেউ। সেই গর্জনের সঙ্গে পাখির কলকাকলি মিশে অন্যরকম এক আবহ সৃষ্টি করছে। শুধু তাই নয়, সকাল বেলায় পূর্বগগনে নদীর বুক চিরে জেগে ওঠা রক্তলাল সূর্য, বেলাশেষে পশ্চিম আকাশে তার হেলে পড়ার দৃশ্য উপভোগ করারও অতুলনীয় স্থান 'ছৈলারচর'। উপকূলীয় জেলা ঝালকাঠির কাঁঠালিয়ার বিষখালী নদীতে জেগে ওঠা চরটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিসেবে জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। প্রতিদিন হাজারো পর্যটক ভিড় করছেন এখানে। যতœআত্তি করলে সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে ছৈলারচর। চরটিতে রয়েছে লক্ষাধিক ছৈলাগাছ। এই গাছের নাম অনুসারেই চরের নামকরণ হয়েছে। পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ রয়েছে নানা সংকট। তবু সেই সংকট উপেক্ষা করেই প্রকৃতির নয়নাভিরাম ছৈলারচর পর্যটকের মিলন মেলায় পরিণত হচ্ছে। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে এই চর। ছৈলারচরকে পূর্ণাঙ্গ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার দাবিতে গত নভেম্বরে মানববন্ধন ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সমকাল সুহৃদ সমাবেশ, দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশ, সুশাসনের জন্য নাগরিক ও পিস ফ্যাসিলেটর গ্রুপ-পিএফজির যৌথ আয়োজনে ছৈলারচরে এ কর্মসূচি পালিত হয়। মানববন্ধন শেষে বক্তব্য দেন সমকাল সুহৃদ সমাবেশ ও উপজেলা সুজন সভাপতি অধ্যাপক আবদুল হালিম, উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান জালালুর রহমান আকন, জেলা পরিষদ সদস্য শাখাওয়াত হোসেন অপু ও এসএম আমিরুল ইসলাম লিটন, মিরুখালী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আলমগীর হোসেন খান, মঠবাড়িয়া প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক দেবদাস মজুমদার, বেতাগী প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও সাপ্তাহিক বিষখালীর সম্পাদক সালাম সিদ্দিকী প্রমুখ। অধ্যাপক আবদুল হালিম বলেন, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এখানে পর্যটন অবকাঠামো গড়ে উঠলে পর্যটকদের যাতায়াত সহজ হতে পারে। আর এ থেকে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় হতে পারে। আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটটি উপজেলা সদর ইউনিয়নের হেতালবুনিয়া মৌজার অধীন। ৭০ একর জমির ওপর চরটি নদীবেষ্টিত। এখানকার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌপথ। এলাকাবাসীর দাবি, হেতালবুনিয়া মাদ্রাসা পর্যন্ত পাকা রাস্তা রয়েছে। শুধু চরে যাওয়ার জন্য একটি ঝুলন্ত সেতু এবং চরের মধ্যে কাঠের সেতু করে দিলে পর্যটকরা সহজেই চরে গিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করতে পারবেন। কাঠালিয়া লঞ্চঘাট থেকে নৌপথে যেতে হয় ছৈলার চরে। ২০১৫ সালে ঝালকাঠি জেলা প্রশাসন ছৈলারচর স্থানটি পর্যটন স্পট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তবে বাস্তবায়ন হয়নি ৬ বছরেও। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য থাকা সত্ত্বেও ছৈলার চরে রয়েছে নানা সমস্যা। এখানে সড়ক পথে যাতায়াতে নেই কোন ব্যবস্থা। সিঁড়ি না থাকায় নৌ পথের পর্যটকদের ছৈলার চরে যেতে হচ্ছে হাঁটু সমান পানি ও কাদা ভেঙে। নেই বিশুদ্ধ পানি ও শৌচাগারের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। চরের মধ্যে হাঁটার জন্য কোন রাস্তা নেই। বিশ্রামের জন্য কোন বিশ্রামাগার না থাকায় অনেক পর্যটক সেখানে যেতে বিমুখ হচ্ছে। পর্যটকদের জন্য কোন নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই। পর্যটন এলাকাকে ঘিরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও রেস্ট হাউজ করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞদের মতে, ছৈলা একটি লবণ সহিষ্ণু বন্য প্রজাতির বৃক্ষ। উপকূলীয় নদী তীরবর্তী চর, জোয়ার ভাটার প্রবহমান খালের চর ও প্লাবনভূমি জুড়ে কোন যতœ ছাড়াই প্রকৃতিগতভাবে জন্ম নেয় এবং বংশ বৃদ্ধি হয় এ বৃক্ষের। ছৈলা গাছের শেকড় মাটির অনেক গভীর অবধি যায় তাই সহসা ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে কিংবা উপড়ে পড়ে না। ফলে উপকূলীয় এলাকায় প্রকৃতিবান্ধব গাছ হিসেবে ছৈলা বনবিভাগের সংরক্ষিত বৃক্ষ। কেবল কাঠের মূল্য বিবেচনায় নয়; মাটির সুদৃঢ় গঠনে পর্যায়ক্রমিক একটি দরকারি বৃক্ষ প্রজাতি হিসেবে ছৈলা গাছকে বিবেচনা করা হয়। তাই দুর্যোগ প্রবণ উপকূলে প্রকৃতিবান্ধব ছৈলা গাছ কাটা নিষেধ। দি হাঙ্গার প্রজেক্ট বরিশাল বিভাগীয় কো-অর্ডিনেটর এবং কাঠালিয়ার সমাজ কর্মী মো. ফারুক হোসেন খান বলেন, উপকূলীয় জেলা ঝালকাঠির দক্ষিণ জনপদ কাঠালিয়ার বিষখালী নদীর তীরে প্রাকৃতিকভাবে জেগে ওঠা নয়াভিরাম ‘ছৈলার চর’ পর্যটন খাতের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও রয়েছে নানা সংকট। প্রতিকূল যাতায়াত ব্যবস্থা ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাবে পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় এ স্থানে পর্যটকরা চিন্তিত থাকেন। তবু সেই সংকট উপেক্ষা করেই প্রকৃতির নয়নাভিরাম এই ছৈলার চর পর্যটকদের মিলনমেলায় পরিণত হচ্ছে। শুকনো মৌসুম এলেই পর্যটকের ভিড় থাকে ছৈলার চরে। বিভিন্ন সরকারী-বেসকারী প্রতিষ্ঠান, স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা এবং বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে স্বপরিবারে পিকনিকে আসে প্রকৃতির সাথে পরিচিত হতে। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি পাবে বিষখালীর তীরে জেগে ওঠা ছৈলার চর। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুফল চন্দ্র গোলদার বলেন, ২০১৫ সালে ছৈলারচরকে পর্যটন স্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে পর্যটন মন্ত্রণালয়ে চিঠিও পাঠানো হয়েছে। পর্যটকদের সুবিধার্থে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন সেখানে গভীর নলকূপ ও ঘাটলা, ওয়াশরুম ও যাতায়াতের জন্য নৌকার ব্যবস্থা করেছে।