মুক্তিযুদ্ধে সবার আগে জিয়াউর রহমানের নাম দেশবাসী শুনেছে!
শনিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২১
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম: করোনার মহাপ্রাদুর্ভাবে দীর্ঘ এক বছর সভা-সমিতি না করে, রাস্তাঘাটে না চলে কেমন যেন অচল হয়ে পড়েছি। দেহের সব কলকব্জায় জং ধরে যাওয়ার উপক্রম।
শরীরটা আগের মতো চনমনে নেই, উদ্দীপনাও নেই। সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের লেখা, ১৯৮৮ সালে আমি তখন যুক্তরাজ্যে ইমিগ্রেশন অ্যাডভাইজরি সার্ভিসের আইনবিষয়ক উপপরিচালক। তখন জেনারেল এরশাদ জেনারেল শওকতকে দেশে ফিরতে বলেছিলেন। জেনারেল শওকতের ভয় ছিল দেশে ফিরলে এরশাদ তাকে জেলে পুরবে। তাই যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় ও বসবাসের জন্য মাইকেল বার্নসের কাছে গিয়েছিলেন। সে সময় জেনারেল শওকত জিয়াউর রহমান যে মুক্তিযোদ্ধা না, ইচ্ছে করে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেননি, বাধ্য হয়ে করেছেন এসব অনেক কথা বলেছেন। শওকত সাহেব বলেছেন, না বলেননি এগুলো নিয়ে আমার কোনো কথা নেই। সাবেক বিচারপতির লেখা থেকে তুলে দিচ্ছি, গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযোদ্ধাদের সবারই যুদ্ধকালীন বহু বীরত্বের কথা বিভিন্ন পুস্তকে, পত্রপত্রিকায় ছাপা হলেও জিয়া কোথাও যুদ্ধ করেছে এমন কোনো খবর কখনো দেখা যায়নি।
মুক্তিযুদ্ধকালে যুক্তরাজ্য প্রবাসী মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ছিলাম বিধায় প্রতিদিন বিলেতের বহু পত্রিকা পড়তাম, বিবিসির খবর শোনতাম। শফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ, মেজর রফিক, কাদের সিদ্দিকী, আ ক ম মোজাম্মেল হক, সি আর দত্ত প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধার কথা প্রায়ই শুনতে পেতাম, কিন্তু জিয়ার কথা কখনো শুনিনি। কর্নেল তাহের হত্যা মামলার বিচারের সময় যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা আমার আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তারা সবাই বলেছেন জিয়া কোনো যুদ্ধ করেনি। গত সপ্তাহে জেনারেল শফিউল্লাহ এবং মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. হারুন-অর-রশিদও একই কথা বলেছেন। জিয়াউর রহমান যুদ্ধ করেছে কি করেনি এটা আমার বিচার্য নয়। চাটুকারিতা আমার স্বভাবে নেই। আমি কারও পোঁ ধরিনি। আর যে কদিন বাঁচব কারও পোঁ ধরব না। সাবেক বিচারপতির এ কথার জবাব দেওয়ার কোনো ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও এটা বলতেই হচ্ছে, যুদ্ধের শুরুতে তিনি শফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ, মেজর রফিক, কাদের সিদ্দিকী, আ ক ম মোজাম্মেল হক, সি আর দত্তদের নাম শুনেছেন।
আমি চ্যালেঞ্জ করলাম আ ক ম মোজাম্মেল হক এখন মুক্তিযদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী। মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীর পরই তার স্থান। তার পরও বলছি, মুক্তিযুদ্ধের সময় জনাব চৌধুরী তো দূরের কথা গাজীপুরের বাইরে একজনও আ ক ম মোজাম্মেলের নাম শোনেননি। তিনি ধীরে ধীরে বড় হয়েছেন। এখন মন্ত্রী তাই তার কথা আলোচনা হয়। কিন্তু তিনি বিরাট মুক্তিযোদ্ধা নন। দু-এক জায়গায় আমিও লিখেছি, ১৯ মার্চ ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবারকে বাধা দিতে আ ক ম মোজাম্মেল হকের ভূমিকা ছিল। মোজাম্মেল হকের চাইতে কিন্তু সে সময় সফর উদ্দিন, নজরুল ইসলাম খানদের ভূমিকা ছিল অনেক বেশি। মুক্তিযুদ্ধে সবার আগে জিয়াউর রহমানের নাম দেশবাসী শুনেছে।
২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে যখন শোনা গিয়েছিল, ‘I, Major Zia, do hereby declare the independence of Bangladesh on behalf of our great national leader Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman!’ ওর আগে কারও নাম শোনা যায়নি। কাদের সিদ্দিকী আমার নাম ৩০ জুলাইয়ের আগে কেউ শোনেনি। ৩০ জুলাই ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে সূত্রাপুর সেতু ধ্বংস করা হলে বিবিসি থেকে বলা হয়েছিল, রাজধানী থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তরে কাদের সিদ্দিকী নামে ২৫ বছরের এক যুবকের নেতৃত্বে প্রতিরোধযুদ্ধ গড়ে উঠেছে। তারই দল ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের সূত্রাপুর সেতু ধ্বংস করেছে। খবরটি আমি নিজ কানে শুনেছিলাম। কেউ চাইলে বিবিসি আর্কাইভ থেকে শুনে নিতে পারেন। এরপর ১১ আগস্ট ভূঞাপুরের মাটিকাটায় পাকিস্তান হানাদারদের সাতটি জাহাজের বহরে আক্রমণ করে সব থেকে বড় দুটি জাহাজ দখল করে বিপুল অস্ত্র উদ্ধার করেছিলাম। এ খবরও বিবিসি থেকে বেশ কয়েকবার প্রচারিত হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের বিরল ব্যক্তিত্ব সাবেক রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী যুক্তরাজ্যে হাউস অব কমন্সে মাটিকাটায় জাহাজ দখলের কথা উল্লেখ করেছিলেন। যখন চারদিক থেকে বলা হচ্ছিল বাংলাদেশে যা কিছু হচ্ছে ভারতীয় সৈন্যরা করছে। সেখানে দেশের মানুষের কোনো অংশগ্রহণ নেই। সেটাকে খন্ডন করতে আবু সাঈদ চৌধুরী বলেছিলেন, সীমান্ত থেকে ২০০ কিলোমিটার ভিতরে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে হানাদারদের যে জাহাজ দখল করেছে যা বিবিসি বারবার প্রচার করছে সেটাও কি ভারতীয়দের কাজ? কাদের সিদ্দিকী আমার পাশের গ্রামের বাসিন্দা। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাকে চিনি।’ জুলাই-আগস্ট থেকে কাদেরিয়া বাহিনীর কর্মকান্ড স্বাধীন বাংলা বেতার এবং আকাশবাণীতে অহরহ প্রচার হতো। এম আর আখতার মুকুলের যেসব প্রচারিত চরমপত্রে ‘কাদেরিয়া বাহিনীর গাবুর মাইর’-এর কথা পাঁচ-ছয় মাসে প্রায় ২৭ বার উল্লেখ করা হয়েছিল। এটা কেমন কথা চৌধুরী সাহেব অন্য সবার নাম শুনলেন জিয়াউর রহমানের নাম শুনলেন না! ২৭ মার্চ কালুরঘাটে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণার পর সারা মুক্তিযুদ্ধের সময় জুড়েই আলোচনা বঙ্গবন্ধুর পরই তো ছিল জিয়াউর রহমানের কথা।
এমনকি স্বাধীন বাংলা বেতার এবং আকাশবাণীতে জিয়াউর রহমানের ঘোষণা বারবার প্রচারিত হতো। জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা না এটা বলে তো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেই কলঙ্কিত করা হয়। তার পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল কি ছিল না সেটা অন্য কথা। কোন বেগ তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে খুশি হয়েছে এটা কোনো কথা না। কাজের কথা জিয়াউর রহমান একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। আমি তো এখনো বেঁচে আছি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আমাদের যে রকম পথ দেখিয়েছিল, ঠিক তেমনি কালুরঘাট বেতারে জিয়ার কণ্ঠ সারা দেশবাসীকে উৎসাহিত করেছিল। সংবিধান দেখিয়ে বাঙালকে হাই কোর্ট দেখাবেন না, মানুষ গ্রহণ করবে না।
মুক্তিযুদ্ধ আর মুষ্টিযুদ্ধ এক নয়। তাই মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর খেতাব বাতিল, অং সান সু চির নানান খেতাব বাতিল আর মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বসূচক খেতাব বাতিল এক কথা নয়। এটা বলতেই হবে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা জন্ম দেয়নি, এ ভূখন্ডের আলো-বাতাস-মা-মাটি ও মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্ম দিয়েছে। আর সেই মুক্তিযোদ্ধারা রক্ত ঢেলে বাংলাদেশের সৃষ্টি করেছে। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে হেলাফেলা করা আগুন নিয়ে খেলার শামিল। কেন এসব করতে যান? মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যথেষ্ট ছেলেখেলা হয়েছে। আর নয়, এখন ক্ষান্ত দিন। অন্ধ দৃষ্টিকোণ থেকে জিয়াউর রহমানকে নিয়ে যা খুশি তা করা যায়। কিন্তু নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় জিয়াউর রহমানকে নিয়ে যা তা করা হলে পরিণতি শুভ হবে না। আবারও বলছি, তার ছেলে তারেক রহমান যখন বলে, ‘এক দিনের জন্য হলেও আমার বাবা বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি।’ সেটা যেমন সমর্থন করতে পারি না, তেমনি ভালোমন্দ যা-ই থাকুন জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা না, বীরউত্তম না এটা সমর্থন করা যায় না।