কথায় কথায় যারা মানবাধিকার,সুশাসন ও গণতন্ত্রের ছবক দেয় তারাই উল্টোপথে হাঁটছে!
বৃহস্পতিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১
মো: ওবায়েদ উল্যাহ ভূলন: কোভিড-১৯ হচ্ছে আমাদের জীবদ্দশায় দেখা প্রথম সত্যিকারের বৈশ্বিক সংকট। আমরা যে যেখানেই বসবাস করি না কেন, মহামারিটি প্রতিটি ব্যক্তিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, শিশুদের সবচেয়ে বেশি।
লাখ লাখ মানুষ কেবল দারিদ্র্যের মধ্যে জন্মগ্রহণ করার কারণে বা তাদের জাতি, ধর্ম বা বর্ণের কারণে মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও সুরক্ষা পাচ্ছে না। কোভিড-১৯ এই বৈষম্যের ব্যবধান আরও বাড়িয়ে তুলবে এবং মহামারিটির সামাজিক, অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত প্রভাব আগামী বছরগুলোতে ফিরে ফিরে আসবে।
তবে এই চ্যালেঞ্জগুলোর কারণে আতঙ্কিত বা বিহ্বল হয়ে পড়ার সময় এটা নয়। আমরা যখন ইউনিসেফের ৭৫তম বার্ষিকী শুরু করছি, তখন এটা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরেকটি ঐতিহাসিক সংকটের মাঝে এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সে সময়ে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বিশ্বে শিশুরা যে পরিমাণ সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল তা দেখে সহজেই দিশেহারা হওয়ার মতো অবস্থা ছিল। তবে আমরা পুনরায় সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমরা বিশ্বজুড়ে নতুন স্বাস্থ্য ও কল্যাণ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছি। আমরা গুটি বসন্ত (স্মলপক্স) এবং হিংস্র পোলিওকে পরাজিত করেছি। আমরা জাতিসংঘ গড়ে তুলেছি।
ইতিহাস আরও একবার আমাদের ডাকছে। পূর্ববর্তী বড় বড় বৈশ্বিক সংকটে, বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে মহামারি পর্যন্ত - চুক্তি ও সমঝোতা বিষয়ক আলোচনার জন্য নেতারা একত্রিত হয়েছিলেন। শান্তি পুনরুদ্ধার, পুনস্থাপন ও পুনর্নির্মাণের নতুন উপায় গড়ে তোলা এবং সহযোগিতার বিষয়ে তারা সময়ে সময়ে সম্মত হয়েছেন।
আমাদের শিশুদের সুরক্ষার জন্য একটি বাস্তবভিত্তিক ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার পেছনে বিশ্বকে একত্রিত করা প্রয়োজন; যেখানে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বিনিয়োগ এবং আরও স্থিতিস্থাপক ব্যবস্থা ও সেবা কাঠামো গড়ে তোলার বিষয়ে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমাদের প্রজন্মের একটি প্রতিশ্রুতি থাকবে। বাজেট স্বল্পতা ও অর্থনৈতিক মন্দায় যাতে শিশুদের কোনো ক্ষতি না হয় তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতিও থাকবে।
বিশ্বের শিশুরা যে ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে সে বিষয়ে আমাদের স্বচ্ছ দৃষ্টি রাখার পাশাপাশি আমরা আমাদের ভবিষ্যত নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও আত্মবিশ্বাসী হওয়ার মাধ্যমে অতীতের ওপর ভিত্তি করে অংশীদারিত্ব ও সংহতিকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।বিশ্ব যখন নাকানিচুবানি খাচ্ছে করোনা মোকাবিলায়, তখন তার প্রতিরোধক হিসেবে আবিষ্কৃত টিকা কেন সব দেশ সমানভাবে পাচ্ছে না? অথচ এটা সবারই জানা যে করোনা এখন বৈশ্বিক অতিমারি। বৈশ্বিক অতিমারি হলে তো তাকে বৈশ্বিকভাবেই মোকাবিলা করা উচিত। কিন্তু তা হচ্ছে কোথায়? বরং বেদনার সাথে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে এটা নিয়ে মুনাফা এবং ভূ-রাজনীতির সমীকরণে পাল্টে যাচ্ছে দৃশ্যপট।
উন্নত দেশগুলো এখন করোনা সংক্রমণ কাটিয়ে স্বাভাবিকের দিকে অগ্রসর হওয়া শুরু করলেও মধ্য এবং নিম্ন আয়ের দেশগুলো তা পারছে না। অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না।
আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, কানাডা, জার্মানি ইত্যাদি দেশসমূহ, যারা কথায় কথায় মানবাধিকারের কথা বলে, দেশে দেশে সুশাসন ও গণতন্ত্রের ছবক দেয়, তারা এমন অতিমারিতে উল্টোপথে হাঁটছে কেন? বিশ্ব মানবাধিকার প্রসঙ্গ এখন কোথায় গেল? এমন তো নয় যে তারা এই অতিমারির প্রকোপকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। তারা তো গত বছরই করোনায় নাকানিচুবানি খেয়েছে। তাহলে টিকা ব্যবস্থাপনা নিয়ে তারা কেন অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে? এটাকে সারা বিশ্বের জন্য কেন উন্মুক্ত করছে না? টিকার পেটেন্টকে কেন এখনও নিজেদের কবজায় রেখেছে? কেন টিকা তৈরিতে সক্ষম এমন দেশগুলোর কাছে এ প্রযুক্তি ও তা তৈরির কাঁচামাল হস্তান্তর করছে না?
আবার পুঁজিবাদকে নিত্য গালি দেওয়া সমাজতান্ত্রিক দেশ চীন ও রাশিয়াও করোনার টিকা আবিষ্কার করেছে। তারাও তো দেখছি সেই পুঁজিবাদী দেশের মতোই আচরণ করছে। তারা নিজেরা এটা যথেষ্টভাবে তৈরি করে নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে দিচ্ছে না। আবার তাদের প্রযুক্তিও হস্তান্তর করছে না। তার মানে টিকা নিয়ে রাজনীতিতে কথিত পুঁজিবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক দেশের অবস্থান সমমেরুতে এবং সমানে সমান।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এমনটা আশঙ্কা করে আগেই সতর্ক করে বলেছিল, টিকা যাতে ধনী দেশগুলোর কুক্ষীগত না হয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলছে। সার্বিক বিচারে দেখা যাচ্ছে, যে দেশ অর্থের বিনিময়ে যত বেশি টিকা কেনার অগ্রিম ব্যবস্থা করেছে, টিকার সিংহভাগ তাদের ঘরেই চলে গেছে। ফলে বঞ্চিত হচ্ছে দরিদ্র দেশগুলো।
আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডার ন্যায় বিত্তশালী দেশ টিকা দেওয়ার কাজকে বহু দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। তারা বয়স্কদের টিকা দেওয়ার কাজ শেষ করেই শিশু-কিশোরদের জন্য টিকার ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে। সেখানে গরিব দেশগুলো তাদের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকেই টিকা দিতে পারছে না। ল্যাটিন আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকার দিকে তাকালে টিকা নিয়ে বিশ্ব রাজনীতির মোড়লিপনা এবং ভূ-রাজনীতির অপকৌশল একদম পরিষ্কার হয়ে যাবে।
বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮৫ ভাগ মানুষ বাস করেন বিশ্বের মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে। অন্যদিকে, উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে বসবাস করেন বিশ্বের মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ। অথচ মোট প্রতিষেধকের নাকি প্রায় ৪৫ শতাংশই এই দেশগুলোর হাতে রয়েছে। এমতাবস্থায় গরিব দেশগুলোর জন্য করোনা টিকা সরবরাহের জন্য গঠিত কোভ্যাক্স তার কাজ করতে পারছে না। কারণ, টিকা উৎপাদন, সরবরাহে ঘাটতি এবং অর্থসাহায্য না পাওয়ায় এ নিয়ে সত্যিকারের সুফল মিলছে না। আফ্রিকার অধিকাংশ দেশে স্বাস্থ্য অবকাঠামোর অবস্থা কেমন, আমরা তা ধারণা করতে পারছি। ফলে সেখানে সমস্যা আর এক রকমের তৈরি হয়েছে। কারণ, টিকা গ্রামীণ অঞ্চলে পৌঁছানো এবং তার যথাযথ প্রয়োগ সম্ভব হচ্ছে না।
শুরুতেই যে অল্প সংখ্যক দেশ টিকা-কাজ শুরু করে জনমনে স্বস্তি দিতে পেরেছিল, আমাদের বাংলাদেশও ছিল সেই কাতারে। কিন্তু আচমকা ইন্ডিয়ায় করোনা-পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি, আমেরিকা থেকে সেরাম ইনস্টিটিউটকে কাঁচামাল না দেওয়া, বিশ্ব ভূ-রাজনীতির জটিল সমীকরণ; সবকিছু মিলিয়ে আমরা এখন একটা জটিল অবস্থায় পড়ে গেছি। কারণ, অক্সফোর্ডের টিকার প্রথম ডোজ পাওয়া কয়েক লাখ মানুষ এখন দ্বিতীয় ডোজ পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছেন। এ অবস্থায় সরকার অবশ্য বসে না থেকে নতুন করে চীন থেকে টিকা কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। হয়তো রাশিয়া থেকেও টিকা আসবে। এ অবস্থায় দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার যাদের সময় হয়ে এসেছে, তাদের জন্য কী করা যায় সেটা নিয়েও ভাবতে হবে।
পরিশেষে বলব, আঁধারের পরে যেমন আলো আসে, তেমনই আমরাও এ সংকটকে কাটিয়ে উঠতে সমর্থ হব। সেইসাথে ভূ-রাজনীতির কূটচাল ও জাল ছিন্ন হয়ে করোনার টিকাও সবার জন্য উন্মুক্ত হোক। বিশ্ব হয়ে উঠুক নিরাপদ।