ফারুক-ই-আজম বলেন, আমরাসহ প্রতিবেশী সবাই সজাগ (কনসার্ন)। আমার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করছে। বিভিন্ন সাংগঠনিকভাবে ও ব্যক্তিগতভাবে আমরা সবাই কনসার্ন। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা বিগত আন্দোলনের সময় ইমেজ সংকটে পড়ে গেছি। কোটাভিত্তিত একটা আন্দোলন ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয় শুধু দেশে নয়, সারা বিশ্বেই এটি আলোচিত হয়েছে যে মুক্তিযোদ্ধারা সুবিধাভোগী, সুবিধা গ্রহণ করেছে।
ফারুক-ই-আজম বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের এই ইমেজ সংকট কাটানোটা আমার জন্য প্রথম দিকের কাজ ছিল। সেটার জন্য যে পদ্ধতি নেওয়ার দরকার সেটি গ্রহণ করেছি। এখানে অনেক মামলা আছে। মামলাগুলোর আদালতে নিষ্পত্তি করার জন্য লড়াই (কনটেস্ট) করে আগাতে হবে।
উপদেষ্টা বলেন, জামুকা গঠিত হয়েছে, জামুকার সভা হয়েছে। সেখানে অনেক ফাইন্ডিং বেড়িয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আসতে পারে। সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধারা যাতে মূল্যায়ন হয়। যারা মাঠে যুদ্ধ করেছে, যারা নানা আঙ্গিকে সহযোগিতা করেছে সবাইকে সমান আঙ্গিকে সম্মান দিতে হবে। যারা রিয়েলি মাঠে যুদ্ধ করেছে মুক্তিযোদ্ধারা মানতে পারছে না। এটার বিভিন্ন ধরনের সংজ্ঞা ছিল। তারমধ্যে যেটি যৌক্তিক সেটি আমরা চূড়ান্ত করব।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা আরও বলেন, জামুকা গঠিত হয়েছে আইনের ধারায়, অথচ এত বছর হলেও এটার কোনো বিধি রচিত হয়নি। কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, কার কাছে কে দায়ী হবে, এটার জন্য বিধি রচিত হওয়ার কথা। কিন্তু, কোনো বিধি রচিত হয়নি। ফলে একটা তুগলকি কারবার হয়েছে। আমি বলেছি, উনি বলেছেন মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, এরকম ২/১ জন ইন্টারভিউ নিয়ে হতে পারে না। এটি বিধি অনুসারে হওয়া উচিত ছিল।
উপদেষ্টা আরও বলেন, এখনো সুনির্দিষ্ট করতে পারিনি কত মানুষ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটেড হয়েছে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা প্রশ্নের সম্মুখীন। সঠিক মুক্তিযোদ্ধা কারা তার যাচাই হওয়া উচিত। এই তালিকা চূড়ান্ত হওয়া উচিত ছিল ১৯৭২ সালেই। যুদ্ধের পর পর হয়ে যাওয়া দরকার ছিল। কারণ সব মানুষের কাছে তথ্য ছিল। তখন তালিকা করা সহজ ছিল। সেটা না হয়ে বলা হচ্ছে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধারা এত পবিত্র, সেখানে আরোপিত কিছু গ্রহণ করতে পারি না। যদি বস্তুনিষ্ঠতা থাকত তাহলে প্রতিটি শহীদের একটা গল্প থাকত। যিনি যুদ্ধে গেছেন কমিটিতে গেছেন, আদর্শিকভাবে গেছেন। এই শহীদদের এরকম গল্প আমরা বেশি পাই না।
উপদেষ্টা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে ৫ হাজার ২৮৬ জনকে শহীদের ভাতা দেওয়া হয়। তাহলে আমরা এত বড় সংখ্যা বলি, এরা কেন ভাতা পাবে না। মন্ত্রণালয়ে প্রথমে আমি এসে জিজ্ঞাসা করলাম এদের তালিকা হওয়ার কথা। তালিকাটা কই। তারা বলছে স্যার তালিকা নাই। বলছে গণসই, আমি বলছি গণসই তালিকাটা কোথায়? সেটাও নাই। যারা এইসব আরোপিত করেছে, মানে যুদ্ধের পবিত্রতার ওপরে যারা এসব আরোপিত করেছেন, সেটার জন্য কখনো প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি।
আপনি ৩০ লাখ শহীদ এটিকে তাহলে আরোপিত বলছেন? এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, এটার তো কোনো বস্তুনিষ্ঠ তথ্য নেই। আমার মনে হচ্ছে তো এটা আরোপিত। কারণ এটার তো একটা পরিসংখ্যান থাকবে। এই সংখ্যা কোথায় থেকে আসছে। গুনেছে কে? এখনকার শিশুদের মধ্যে প্রশ্ন জাগছে, এটার তো কোনো বস্তুনিষ্ঠ পরিসংখ্যান নাই। তো পরিসংখ্যান ছাড়া এটা এলো কোথা থেকে?
আপনি কী এটির ফ্যাক্ট ফাইন্ড করবে কিনা এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, এটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার। ৫০ বছর পরে এসে এটি কি সম্ভব? এটা ফ্যাক্ট ফাইন্ড কীভাবে সম্ভব? হওয়া তো উচিত ছিল। এটা ৩ কোটি হলেও আমার আপত্তি নাই। যদি এটার কোনো একটা বস্তুনিষ্ঠতা বা এটার একটা পরিসংখ্যান পাওয়া যেত, এটার একটা গণনা পাওয়া যেত, তাহলে তো কোনো সমস্যাই ছিল না।
উপদেষ্টা বলেন, আমরা বীরাঙ্গনাদের কথা বলছি। আমরা বীরাঙ্গনাদেরকে ভাতা দিচ্ছি। অবশিষ্ট বীরাঙ্গনারা কোথায়? কেউ বলে লজ্জায় বলে নাই, আসে নাই, এটা সঠিক কথা না। এটা হওয়ার কথা না। এটার বাস্তবভিত্তিক কোনো প্রমাণ নাই। তাহলে কেন বাড়িয়ে বলছি। একজন নারী যুদ্ধের জন্য সম্ভ্রম হারিয়েছে, এটা হিমালয় পর্বতের মতো বিষয়।
আরেক প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধ উপদেষ্টা বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা আমরা যাচাই-বাছাই করছি। বর্তমান তালিকা আমরা ডোমেইনে হোস্ট করে দিচ্ছি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে। এরপর নিচে একটা আপত্তি ফরম যুক্ত করে দিয়েছি। সেখানে বলেছি, এরা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, আপনার কোনো আপত্তি থাকলে জানাতে পারেন। এসব আপত্তি ফরমগুলো সংগ্রহ করে আমরা যাচাই-বাছাইয়ে যাব। যেগুলো মামলা হয়েছে, মামলাগুলোতেও আমরা অংশ নেব। সেখানে আদালত থেকে যদি রায় পাওয়া যায়, তাহলে মামলার রায় বাস্তবায়নে যাব।
কতগুলো মামলা আছে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, ৩ হাজার ৭৭৭টির মতো মামলা আছে।
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যারা ভাতা নিচ্ছেন, তাদের ভাতার টাকা ফেরত বা কী ব্যবস্থা নেবেন জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, আমরা যদি এরকম কোনো সুনির্দিষ্ট ফাইন্ডিংস পাই তাহলে ব্যবস্থা নেবো। কারণ রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতারণা করার জন্য শাস্তিও দিব। তাহলে হয়তো অনেকের বোধোদয় হবে, আমরা তাদের থেকে নিষ্কৃতিও পাব।
ফারুক-ই-আজম আরও বলেন, যারা মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও মুক্তিযোদ্ধা সেজে আছেন, তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। তারা যদি সঠিক প্রমাণ না দিতে পারে তাহলে তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাতিল করব। তারা যে দীর্ঘদিন মুক্তিযোদ্ধা সেজে সুবিধাগুলো নিয়েছে, তাদের শাস্তির আওতায় আনব। যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জামুকা কাউন্সিল সদ্য গঠিত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদটাও গঠন হবে খুব শিগগিরই। তাদের মাধ্যমে এ সহযোগিতাগুলো নেব।
উপদেষ্টা বলেন, আমরা সবাই জানি, সবার মনে লজিক্যাল একটা প্রশ্ন এটি। যখন ভাতা ছিল ৩০০ টাকা তখন মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য কেউ আসে নাই। যখন সুবিধা আসা শুরু হয়েছে, চাকরিতে সিনিয়রিটি, চাকরিতে বয়স বৃ্দ্ধি, চাকরি হওয়া এবং ভাতা যখন বাড়ছে, তখন তারা এইসব ছিদ্র দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা আসছে- আসলে তারা মুক্তিযুদ্ধ করে নাই।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা তখন ৯০ ভাগ ছিল কৃষক ও গরীব। তারা মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ সুবিধা নেওয়ার তখন সুযোগ ছিল না। তারা মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নিবে সেই যোগ্যতাও ছিল না। দীর্ঘকাল মানুষ এসব বিষয় নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিল না। মুক্তিযোদ্ধারা সাধারণত গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই পরিচিত। এখনো যদি গ্রামে যান, গ্রামের মানুষের মধ্যে কারা মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধা না, আসল তথ্য জানতে পারবেন।
মুক্তিযোদ্ধা তালিকা নতুন করে করবেন কিনা জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, না তালিকা করব না। যে তালিকা আছে, সেটি থেকে কারা মুক্তিযোদ্ধা না সেই তালিকা বের করব। বর্তমানে তালিকা থেকে অমুক্তিযোদ্ধাদের বাছাই করে বের করা হবে।
উপদেষ্টা বলেন, এটা আমার কাছে সবসময় বিস্ময়কর মনে হয়। দেখেন মুক্তিযুদ্ধ হওয়ার ৫০ বছর পার হয়েছে। এটা কিন্তু একদিন দুদিনের ঘটনা নয়। অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছেন। তার সন্তানরা এসে বলছেন আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এই বিষয়গুলো আমরা কীভাবে নীরিক্ষা করব। এটার তো একটা নিরীক্ষার প্রয়োজন আছে। অন্য একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ত বলছে সে মুক্তিযোদ্ধা ছিল। অধিকাংশ জায়গায় মুক্তিযোদ্ধারাই অনাচারে যুক্ত হয়ে যাচ্ছেন।
সুযোগ-সুবিধা ও ভাতা বেশি দেওয়ায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আসছে। তাহলে কী এই সুযোগ বা ভাতা কমানোর কোনো পরিকল্পনা আছে কি না। এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, না, যে সুযোগ সুবিধা ও ভাতা আছে তা কমানোর কোন উদ্যোগ নেই। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা তারা মনে করেছেন কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না। এই ধারণা সঠিক ছিল না। সচিবসহ যারাই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নিয়ে সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন, প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, ২ লাখ ৭ হাজার ৬৬৪ জন মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছেন। তারমধ্যে রয়েছেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা।