রোয়ানুল ইসলাম, স্টাফ রিপোর্টার: মাদক ও ইয়াবার হটস্পট হিসেবে পরিচিত রাজধানীর কারওয়ান বাজারের রেলওয়ে এলাকা। এখানে ইয়াবা ও মাদক ব্যবসায়ীরা রাস্তায় অপরাধীদের দৃষ্টি আকর্ষণে নানা কৌশল প্রয়োগ করে চালাচ্ছেন মাদকের ব্যবসা।
এর একটি হলো— ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণে তারা বলে থাকেন ‘তামাক-বাবা’ লাগবে কি?
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) শিথিল মনোভাবের কারণে এলাকাটিতে প্রকাশ্যে ও অবাধে চলছে অবৈধ মাদকদ্রব্য বিক্রি।
সম্প্রতি কারওয়ান বাজার রেলওয়ে এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, মাদক বিক্রির জন্য ক্রেতাদের অপেক্ষা করছেন মাদককারবারীরা। আরও ক্রেতারাও প্রকাশ্যে তাদের কাছে কিনছেন মাদক। যেন জমে উঠা একটি হাট-বাজার!
পঞ্চাশোর্ধ্ব এক মাদক ব্যবসায়ী ঝর্ণা পরিচয় দিয়ে আমাদের সংবাদদাতার কাছে এসে জানতে চান, ‘তামাক-বাবা’ লাগবে কিনা।
ইউএনবির এই সংবাদদাতা কী বোঝাতে চেয়েছেন— তা বুঝতে পারছেন না বলে জবাব দিলে ঝর্ণা ব্যাখ্যা করেন, তামাক মানে গাঁজা। যা গাঁজা বা হেম নামেও পরিচিত এবং বাবা অর্থ নিষিদ্ধ ইয়াবা বড়ি।
ইউএনবির এই প্রতিবেদক দাম জানতে চাইলে ঝর্ণা বলেন, একটি ছোট প্যাকেট গাঁজা ১০০ টাকা এবং একটি ইয়াবা বড়ির দাম ৩০০ টাকা।
এরই মধ্যে আনুমানিক ৬০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি ঘটনাস্থলে এসে আমাদের প্রতিবেদকের কাছে জানতে চান, তার হেরোইন লাগবে কিনা? যার দাম পড়বে ৩০০ টাকা।
তাদের কাছ থেকে এলাকায় অবৈধ মাদক ব্যবসার বিষয়ে কিছু তথ্য পেতে ইউএনবির এই প্রতিবেদক ওই নারীর কাছ থেকে এক পুরিয়া গাঁজা কেনেন।
ইউএনবির সঙ্গে আলাপকালে ঝর্ণা বলেন, এই অঞ্চলে বেশ কিছু নারী ও যুবক অবৈধ মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এবং তাদের নিয়ন্ত্রণকারী বেশ কয়েকজন লাইনম্যানও আছেন।
সেখানে পুলিশ, র্যাব বা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের লোকজন নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে কিনা জানতে চাইলে ঝর্ণা বলেন, তারা ততটা সক্রিয় নয়। কিন্তু যখন তারা তা করে, বেশিরভাগ সময় তারা কোনো না কোনোভাবে আগাম সতর্কতা পায়।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, বছরের পর বছর মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসংখ্য অভিযান সত্ত্বেও ঢাকা মহানগরীর কারওয়ান বাজার রেলওয়ে এলাকা অবৈধ মাদক বিক্রির প্রধান হটস্পট হিসেবেই রয়ে গেছে। মাদক ব্যবসায়ীরা দায়মুক্তি নিয়ে কাজ করায় তারা ক্রমেই হতাশ হয়ে পড়ছেন।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, রেললাইনের ধারে, বিশেষ করে পাইকারি মাছের বাজার এলাকায় শিশু ও নারী মাদক ব্যবসায়ীরা গোপনে অবৈধ মাদক বিক্রি করেন।
এছাড়া তেজগাঁও রেলক্রসিং পর্যন্ত রেললাইনের বিভিন্ন অংশ একাধিক অপরাধী চক্র নিয়ন্ত্রণ করছে বলে জানা গেছে। এমন অভিযোগও রয়েছে যে এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে কয়েকটি স্থানীয় ডিএনসি কর্মকর্তাসহ কিছু আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের সুরক্ষা বা মৌন সম্মতি পান, যা এই অবৈধ ব্যবসাকে বন্ধ করার প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করে তুলেছে।
সমস্যাটি নিয়ন্ত্রণে বড় আকারের অভিযানসহ নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এলাকায় মাদক ব্যবসা অব্যাহত রয়েছে।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালের মে মাসে এলাকায় মাদক ব্যবসা গুঁড়িয়ে দিতে প্রায় এক হাজার সদস্যের একটি বড় দল নিয়ে অভিযান চালায় পুলিশ। তবে, গোপনীয়তার অভাবের জন্য এই অভিযানটি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েঠিল। কারণ কর্তৃপক্ষ প্রকাশ্যে আগাম অভিযানের ঘোষণা দেওয়ায় মাদক ব্যবসায়ীদের পালানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় পেয়েছিল।
যদিও ৪৭ জনকে আটক করা হয়েছে, তবে অনেকে দিনমজুর বা রাস্তার বিক্রেতা বলে জানা গেছে। যাদের অবৈধ মাদক ব্যবসার সঙ্গে কোন স্পষ্ট সংযোগ নেই। এতে করে নিরপরাধ ব্যক্তিদের অকারণে ক্ষতিগ্রস্ত করার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
পরে ২০২৪ সালের শুরুর দিকে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) আরেকটি অভিযান চালালেও তাতেও সীমিত ফল পাওয়া যায়। আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তারা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ইয়াবা এবং গাঁজা জব্দ করেছে। তবে সমালোচকদের দাবি, এই অভিযানগুলোতে মাদক ব্যবসায়ীদের নেটওয়ার্কগুলো ভেঙে ফেলার জন্য ধারাবাহিক পদক্ষেপ বা দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের ঘাটতি রয়েছে। মাঝেমধ্যে শীর্ষ ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার এবং জব্দ হওয়া সত্ত্বেও এই অঞ্চলে মাদক ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠছে।
চলমান মাদক ব্যবসার সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এলাকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা। প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি এই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতায় বাড়াচ্ছে। এর ফলে কিছু ব্যবসা তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যায় বা স্থানান্তরিত হয়। আশেপাশের বাবামায়েরাও শিশু ও তরুণদের ওপর প্রভাব সম্পর্কে উদ্বিগ্ন, যারা প্রায়শই এই ব্যবসার সংস্পর্শে আসে।
কারওয়ান বাজার এলাকার ব্যবসায়ী সালামত উল্লাহ বলেন, অবৈধ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে অবৈধ বাণিজ্য অব্যাহত রয়েছে। অবৈধ মাদক ব্যবসা বন্ধে এবং কারওয়ান বাজার রেলওয়ে এলাকায় শৃঙ্খলা ফেরাতে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে আরও ভাল সমন্বয়, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং কমিউনিটির সম্পৃক্ততাসহ ব্যাপক সংস্কার আবশ্যক।
এ বিষয়ে র্যাব-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি খলিদুল হক হাওলাদার কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
কারওয়ান বাজার রেললাইন এলাকায় প্রকাশ্যে অবৈধ মাদক বিক্রির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ডিএনসির মহাপরিচালক খন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মাদক ব্যবসা রোধে ডিএনসির অপারেশনাল টিম ওই এলাকায় ধারাবাহিকভাবে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু অভিযান চালিয়ে অবৈধ মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, বরং চাহিদা কমানো প্রয়োজন। চাহিদা বাড়লে সরবরাহ বাড়বে। চাহিদা কমাতে তারা সারাদেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানা মোটিভেশনাল ক্যাম্পেইন পরিচালনা করছে।
ডিএনসি মহাপরিচালক বলেন, অভিভাবকদের পারিবারিক পর্যায়ে তাদের সন্তানদের সম্পর্কে সচেতন হতে হবে, যাতে তারা (শিশুরা) মাদকাসক্তিতে জড়িয়ে না পড়ে।
কারওয়ান বাজারের অবৈধ মাদকের হটস্পট সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোবারক হোসেন ইউএনবিকে বলেন, গত ৩ থেকে ৪ মাসে তারা অন্তত ৫০ জন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করেছেন। এছাড়া ডিএমপির গোয়েন্দা শাখাও (ডিবি) মাঝে মাঝে অভিযান চালায়। এতো কিছুর পরও অবৈধ মাদকের ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠছে।
ওসি আরও বলেন, মাদকের অবৈধ ব্যবসা রোধে বড় ধরনের অভিযান চালানোর পাশাপাশি সার্বক্ষণিক ভ্রাম্যমাণ দল প্রস্তুত রাখার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।