বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
সৈয়দ বদরুল আলম, নিজস্ব প্রতিনিধি: ১৯৭১ সালে যারা রণাঙ্গণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছেন শুধু তারাই মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা পাবেন। অন্যান্য যারা দেশ-বিদেশ থেকে স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করার প্রয়াসে সংগঠকের ভূমিকা পালন, বিশ্বজনমত গঠন, কূটনৈতিক সমর্থন অর্জনে কাজ করেছেন তারা হবেন ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’।
বর্তমান আইনে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা
বর্তমান আইনে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা তুলে ধরে ফারুক-ই-আজম বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়া যাহারা দেশের অভ্যন্তরে গ্রাম-গঞ্জে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এবং ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়ে দখলদার ও হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও মুসলিম লীগ এবং তাহাদের সহযোগী রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, মুজাহিদ বাহিনী ও পিচ কমিটির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন এইরূপ সকল বেসামরিক নাগরিক এবং সশস্ত্র বাহিনী, মুজিব বাহিনী, মুক্তি বাহিনী ও অন্যান্য স্বীকৃত বাহিনী, পুলিশ বাহিনী, ইপিআর নৌ কমান্ডো, কিলো ফোর্স, আনসার বাহিনীর সদস্য এবং নিম্নবর্ণিত বাংলাদেশের নাগরিকরা, উক্ত সময়ে যাহাদের বয়স সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বয়সসীমার মধ্যে, বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গণ্য হইবেন। এটা বর্তমান আইনে বলা হয়েছে।’
বর্তমান সংজ্ঞায় সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেননি এমন আট ধরনের ব্যক্তি ও পেশাজীবীদের বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ভারতে গিয়ে যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, যারা বিদেশে থেকে যুদ্ধের ওপর জনমত গঠন করেছেন, মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী-দূত, মুজিবনগর সরকারে সম্পৃক্ত এমএনএ এবং যারা পরবর্তীতে গণপরিষেদের সদস্য হিসেবে গণ্য হয়েছিলেন, বীরঙ্গনা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও কলাকুশলী এবং দেশ ও দেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দায়িত্ব পালনকারী বাংলাদেশি সাংবাদিক; স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সব খেলোয়াড়, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া মেডিকেল দলের সব সদস্যদের বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল বলেও জানান উপদেষ্টা।
খসড়া অধ্যাদেশে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়া’ অংশটুকু বাদ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে ফারুক ই আজম বলেন, নতুন অধ্যাদেশে হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাহাদের সহযোগী কর্তৃক নির্যাতিতা সকল নারী (বীরাঙ্গনা); মুক্তিযুদ্ধকালে আহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া ফিল্ড হাসপাতালের সকল চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসা-সহকারীকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
উপদেষ্টা আরও বলেন, বর্তমান আইনে সংজ্ঞার ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাখ্যা হচ্ছে, যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ করেছে। কারো নির্দেশে না। বর্তমান সংজ্ঞায় সেটি কারো নির্দেশিত বলা হয়েছে। মনে হচ্ছে, আমরা যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু কারো ডাকে সাড়া দিয়ে গিয়েছি। এটা তো তেমন না। মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, আমরা দেশ-জাতি-মানুষকে ভালোবেসে রণাঙ্গণে যুদ্ধ করতে গেছি। হয় আমরা জীবন যাবে, না হয় শত্রুর জীবন। একমাত্র ভালোবাসাই মানুষকে জীবন দেওয়ার মতো একটা প্রেক্ষিতে নিয়ে যেতে পারে। কারো নির্দেশ কেউ জীবন দিতে যেতে পারে না।
খসড়া অধ্যাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীদের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যারা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে দেশের অভ্যন্তরে বা প্রবাসে অবস্থান করে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করা এবং মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করার প্রয়াসে সংগঠকের ভূমিকা পালন, বিশ্বজনমত গঠন, কূটনৈতিক সমর্থন অর্জন এবং মনস্তাত্ত্বিক শক্তি অর্জনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের যেসব নাগরিক প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করেছেন। বর্তমান আইন অনুযায়ী, এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত।
উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন পর্যায় থেকে খসড়া অধ্যাদেশের বিষয়ে জনমত নিয়েছি। সেই মতামত আমরা বিবেচনায় নিয়েছি। গত রোববার (২৩ ফেব্রুয়ারি) আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে বসেছি। তারাও নানা রকমের মতামত দিয়েছেন। আমাদের খসড়া ও তাদের মতামত মোডিফিকেশন করে আগামী জামুকার (জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল) সভায় চূড়ান্ত করে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। ইতোমধ্যে অধ্যাদেশের ভেটিংও হয়ে গেছে।’
আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে জামুকার সভা হবে জানিয়ে ফারুক ই আজম বলেন, ‘আমরা আশা করছি মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে এটা উপদেষ্টা পরিষদে পাঠাতে পারব।’
মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সের বিষয়ে জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা হতে হলে সর্বনিম্ন বয়স মুক্তিযুদ্ধের সময় ১২ বছর ৬ মাস নির্ধারিত আছে। কিন্তু এটা নিয়ে মামলা রয়েছে। মামলা নিষ্পত্তি হলে রায়ে ভিন্ন কিছু না থাকলে এ বয়সই বহাল থাকবে। মামলা নিষ্পত্তির জন্য দ্রুত চেষ্টা করা হচ্ছে। আদালত ১২ বছর ৬ মাস বহাল রাখলে প্রচুর অমুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ যাবেন।’
উপদেষ্টা জানান, মুক্তিযোদ্ধা সকল সংগঠন একটা দাবি জানিয়েছে, ভুল তথ্য দিয়ে যারা মুক্তিযোদ্ধা সুবিধা নিয়েছেন, তারা ক্ষমা চেয়ে ২৬ মার্চের মধ্যে আবেদন করলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার জন্য। এটি বিভিন্ন সংগঠনের দাবি। এ বিষয়ে সরকার এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে এ বিষয়ে আমরা ইতিবাচক বিবেচনায় রেখেছি।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এখন দেশে জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৯১ হাজার ৯৯৮ জন। ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত গেজেটভুক্ত মোট মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৫৬ হাজার ৪৭৬ জন।