যে ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধু মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য উদাত্ত আহবান জানিয়ে বলেছিলেন, " আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকামিলা কর"। লালসবুজের পতাকায় দেশ হাসছে। কিন্তু জাতির সেই হাসির মাঝেও উৎকণ্ঠা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। তিনি তখনো পাকিস্তানে কারাগারে। তাঁকে নিয়ে ঘরে বাইরে চারদিকে নানা গুজব। ছাত্র লীগ ও মুজিব বাহিনীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব গুজবের মাত্রাকে প্রকট করে তুলেছে। তারা বিজয়ের পরপরই প্রথম সপ্তাহে ঘোষনা করে বসলো। রেস কোর্স ময়দানে সাত মার্চ-১৯৭২ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে জনসভা হবে। বিভিন্ন মহল গুজব রটালো- প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে আন্তরিক নন। এরকম গুজবের মুখে তাজউদ্দিন ছুটে গেলেন বেগম মুজিবের কাছে।তখন ধানমন্ডির ১৮ নম্বর বাসায় থাকেন তাঁরা। অথচ, বিভিন্নভাবে তাজ উদ্দিন ততপরতা চালাচ্ছিলেন। জাতিসংঘ মহাসচিব, ইউরোপের অধিকাংশ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করলেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বললো- শেখ মুজিবের যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে তার ফলাফল হবে ভয়াবহ। এতে কাজ হলো। ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি করাচির জনসভায় পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবের মুক্তিদানের সরকারি সিদ্ধান্তের কথা ঘোষনা করেন।২২ ডিসেম্বর -১৯৭১ অস্থায়ী সরকার রাজধানী স্থানান্তর করে ঢাকায় আসে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমেদ, অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান গভর্নর হাউসে (বঙ্গভবন)। কিন্তু শুধু পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ গিয়ে উঠলেন তার আগামসি লেনের বাসভবনে। তাজ উদ্দিন মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করে মোশতাক কে বাদ দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রী করেন আব্দুস সামাদ আজাদকে। শুধু তাই নয় মোশতাক পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে কনফেডারেশন গঠনের প্রয়াস চালাচ্ছিল - এরকম অভিযোগে জাতিসংঘে প্রতিনিধি দলের নেতা হিসাবে মোশতাক কে বাদ দিয়ে লন্ডনে দায়িত্ব রত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী কে পাঠানো হয়। আইন মন্ত্রী করা হলেও মোশতাক শপথ না নিয়ে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি হন।। সকল গুজবের অবসান ঘটে ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি দিবাগত রাতে একটি চার্টার্ড বিমানে করে লন্ডনের পথে পাঠিয়ে দিয়েছে মর্মে বিবিসির খবরে। এ খবরে আনন্দের বন্যা বয়ে গেলেও তখনো দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে পারেনি দেশের মানুষ। বিবিসি দ্বিতীয় খবরে বলে - বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি সকাল সাড়ে ছয় টায় লন্ডনের হিথরো বিমান বন্দরে পৌঁছেছে। সকাল দশটায় দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবকে বিরল অভিবাদন জানিয়েছেন। ওদিন সন্ধ্যায় ববঙ্গবন্ধু তাঁর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। ৯ জানুয়ারি তাজ উদ্দিন বাসায় গিয়ে বেগম মুজিবকে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশে ফেরার সময় সূচি অবহিত করেন। ৯ জানুয়ারি রাতে লন্ডন ত্যাগ করে পরদিন দিল্লিতে পৌঁছে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী র সঙ্গে কুশল বিনিময় শেষে ভারতীয় একটি বিমানে কোলকাতায় একঘন্টা যাত্রা বিরতি করে বিকাল চারটার দিকে ঢাকা পৌঁছবেন। এমন কমসূচির কথা শুনে এ বেগম মুজিব প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে অনুরোধ করে বলেন, দিল্লিতে বিমানে পরিবর্তন করলে বৃটেন মন:ক্ষুন্ন হতে পারে।তাঁর বৃটিশ বিমানেই ঢাকা আসা উচিত। ততক্ষণে তাজউদ্দিন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ডি পি ধরকে ফোন করে বেগম মুজিবের পরামর্শ অবহিত করেন। সেই মতে দশ জানুয়ারি দুপুরের দিকে বৃটিশ রাজকীয় বিমান "কমেট" দিল্লির পালাম বিমান বন্দরে অবতরণ করে। ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর মন্ত্রিসভা বিশাল অভ্যর্থনা জানান বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সেখানে ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, এক বিরাট সংকল্প নিয়ে আমি ফিরে যাচ্ছি আমার দেশে-বাংলাদেশে। সামনে যে পথ আমরা রচনা করবো তা হবে শান্তি র এবং প্রগতির পথ। কারো জন্যে কোনো ঘৃণা বুকে নিয়ে আমি ফিরছি না । মিথ্যার ওপরে সত্যের জয়, অশুচিতার ওপরে শুচিতার জয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের জয় এবং সর্বোপরি অশুভ ও অসত্যের ওপরে সার্বজনীন সত্যের বিজয়ের প্রেক্ষাপটে আমি ফিরে যাচ্ছি আমার নিজের দেশে-রক্তস্নাত ওপর শুচিতায় উদ্ভাসিত স্বাধীন বাংলাদেশে।
বৃটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর একটি "সাদাকমেট" বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তেজগাঁও বিমান বন্দরে অবতরণ করলো। বিমান থেকে অবতরণের সিঁড়ির মুখে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে প্রিয় নেতাকে অভিবাদন জানানোর জন্য মন্তিসভার সদস্যের আগেই উন্মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, মুজিব বাহিনী ও ছাত্র লীগ তথা স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন, অর্থ মন্ত্রী মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, রাষ্ট্রমন্ত্রী এইচ এম কামরুজ্জামান, পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ । সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকে মাল্যভূষিত করেন, শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আসম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন। একটি ডজ ট্রাকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাত্রা করে রেস কোর্স ময়দান অভিমুখে। ছাত্রনেতাদের নিয়ন্ত্রণবেশ্টিত ট্রাকটিতে গাদাগাঁদি করে দন্ডয়মান ছিলেন মন্ত্রিসভার সদস্যরা। বিকাল তিনটায় অবতরণ করে বিমানটি।
ট্রাক করে দুইঘন্টা র বেশী সময় লাগে রমনার ময়দানে পৌঁছতে। ছাত্রলীগ নেতারা ব্যূহের মতো করে মঞ্চের কাছে নিয়ে আসে বঙ্গবন্ধুকে। লাখ লাখ মানুষের উপচে পড়া ভিড় ঢেলে যখন বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উপবিষ্ট জয়বাংলার গগণবিদারি শ্লোগানে মুখর ময়দানের জনস্রোত। ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদের কন্ঠ মাইকে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে গর্জে শোনালো শেখ মুজিবের উপস্থিতি বার্তা। তোফায়েল আহমেদ '৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের পর ২৩ ফেব্রুয়ারি যে বঙ্গবন্ধু খেতাব দিয়ে ছিলেন সেই অভিধায় শেখ মুজিবকে অভিসিক্ত করে জনসমুদ্রে বললেন, 'ভাইসব' বঙ্গবন্ধু মঞ্চের দিকে আসছেন। কিছুক্ষনের মধ্যে তিন ভাষণ দেবেন। কিন্তু তার আগে বঙ্গবন্ধুর এবং আমাদের নিরাপত্তার জন্যে দয়া করে সবাই বসে পড়ুন। হাত দুটোকে মাটির ওপর রাখুন। সঙ্গে সঙ্গে নজর রাখুন আশেপাশের প্রত্যেকের ওপর। খুনীর হাত যে কোন জায়গা থেকে উঠে আসতে পারে।কড়া নজর রাখবেন। চোখের পলকে বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠলেন। দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নিথর নিরব হয়ে রইলেন। ময়দানে উত্তেজনার উদ্বেল আনন্দ ধ্বনি । বঙ্গবন্ধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নাবিজড়িত কন্ঠে বললেন ১৯৭১সালের ৭ মার্চ আমি বলেছিলাম ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলন, "এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম" আপনারা বাংলা দেশের মানুষ সেই স্বাধীনতা জয় করে এনেছেন।,,,,,, ষড়যন্ত্র এখনো শেষ হয়নি। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি।একজন বাঙালি র প্রাণ থাকতে এ স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেবে না।পাকিস্তানি জেলখানায় নিজের বন্দিদশার কথা উল্লেখ করে বলেন, আমার ফাঁসি র হুকুম হয়েহয়েছিলো আমার সেলের পাশে আমার কবর খোঁড়া হয়েহয়েছিল।আমি মুসলমান । আমি জানি মুসলমান একবারই মরে। তাই আমি ঠিক করেছিলাম , আমি তাদের কাছে নতিস্বীকার করবো না। ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময়ও আমি বলবো, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। ইন্দিরা গান্ধীগান্ধীর সঙ্গে আলোচনাআলোচনার কথা উল্লেখ করে বলেন আমি যখন চাইবো ভারত সরকার বাংলাদেশ থেকে তার সৈন্য বাহিনী তখনই প্রত্যাহার করে নেবেন। ভাভাষণের এক পর্যায়ে কবিগুরু রবীন্দ্র নাথের " রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি" উদ্ধৃতি করে বলেন এবার নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সাড়ে সাতকোটি বাঙালি পুড়ে সোনার মানুষ হয়ে উঠেছে। আপনাদের মুজিব ভাই আহবান জানিয়ে ছিলেন আর সেই আহবানে সাড়া দিয়ে আপনারা যুদ্ধ করেছেন। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন। বাঙালি বীরের জাতি ।পৃথিবীর কোনো শক্তি আমাদের পদানত করতে পারবে না। বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে জুলফিকার আলী ভুট্টো আমাকে অনুরোধ করে বলেছেন সম্ভব হলে আমি যেন লস ফেডারেশন গঠনের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে শিথিল সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করি। তাকে বলেছিলাম আমার জনসাধারণের নিকট আমি ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত আমি আপনাকে একটা ব্যাপারে কিছু বলতে পারবো না। এখন আমি বলতে চাই , ভুট্টো সাহেব আপনারা সুখে সুখে শান্তিতে থাকুন।বাংলা দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখন যদি কেউ সেই স্বাধীনতা নস্যাৎ করতে চায় তাহলে এই স্বাধীনতা রক্ষার করার জন্য শেখ মুজিব সর্ব প্রথম প্রাণ দেবে। জনসভা শেষ করে সদলবলে ছুটে যান শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর মাজারে। ওখান থেকে শহীদ মিনারে। ওখান থেকে সন্ধ্যা র পর ধানমন্ডির বাসায় আসলে এক বাবা মা ভাই বোন স্ত্রী পুত্র কন্যা মাঝে । এরপর ওদিন ছাত্র নেতাদের সঙ্গে আলাপে বসেন। অস্থায়ী মুজিব নগর সরকারের কর্মকান্ড এবং মুজিব বাহিনীর মধ্যে বৈরী সম্পর্কের নেপথ্য ঘটনা বলেন। ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধু বঙ্গ ভবনে ভবনে যান শেখ মনি, রাজ্জাক ও তোফায়েল কে নিয়ে। এরপর ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি পদে ইস্তফা দিয়ে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা জারি করে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন।রাষ্ট্রপতি পদে শপথ নেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।
লেখক: সোহেল সানি সাংবাদিক ও কলমিষ্ট, উপদেষ্টা সম্পাদক সিএনএন বিডি .টিভি।