তাই সত্যি বলতে বর্তমান সময়ে করোনার কারনে ঘড়ে বন্ধি থাকতে হবে এটা মানুষ কখনও ভাবেনি। যাদেরকে এভাবে ছুটাছুটি করতে দেখেছি তারা হয়তো করোনার ভয় বুঝে কিন্তু নিরুপায় কি করবে সিদ্ধান্ত যে নিজেকে নিতে হয়। সরকার বিভিন্নভাবে চাল, ডাল, আলু, তেল ইত্যাদি নিম্ন আয়ের মানুষদেরকে পরিবেশন করছেন। সরকারের পাশাপাশি বেসকারি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে সবাইতো আর সেই সাহায্য পাবে না,পায় না। নিম্ন শ্রেণির মানুষ গুলো এই সাহায্য পাচ্ছে কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের অবস্থা কি? তারাতো আর হাত পাত্তে পারে না। গোটা দুনিয়া হতবাক! পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধ আর অসংখ্য আঞ্চলিক যুদ্ধের ক্ষত যে পৃথিবীর বুকে ফেনিয়ে তুলেছিল রক্ত; সেই বিশ্বযুদ্ধ, সেই সংঘাত পার হলেও এত মৃত্যু, এত স্বজনহারা মানুষ কখনো দেখেনি দুনিয়া।
সময় ভীষণ খারাপ। পৃথিবী ভালো নেই। লকডাউন নামের অদৃশ্য এক খাঁচায় বন্দি পুরো পৃথিবী। আল্লাহর এক আজাব নেমে আসছে আমাদের দিকে। কিছু চিকিৎসক নিজেদের জীবনের মায়া ছেড়ে করে যাচ্ছেন অক্লান্ত পরিশ্রম। পুলিশ-সেনাবাহিনী-ফায়ার সার্ভিস-বিজিবির সদস্যরা খাটছেন আমাদের জন্যই, কেবল আমাদের জন্যই। বিশ্ব নেতারা যখন কভিড-১৯ এর উৎস সন্ধানে জড়িয়ে পড়েছেন নতুন রাজনীতিতে, মাস্ক ছিনতাই করছে যুক্তরাষ্ট্র, তখন বাংলাদেশে সকল নির্দেশনা-গণবিজ্ঞপ্তি উপেক্ষা করে বলতে শোনা যায় ‘আল্লাহ ভরসা’। খোদ আরবীয় সম্প্রদায়ের রাষ্ট্রে মসজিদ বন্ধ করা হলেও দেশে সম্ভব হয়নি। সম্ভব হয়নি পোশাক কারখানার মালিকদের কথা শোনাতে। যে কারখানা মালিকরা শ্রমিকদের দাস ভেবে টাকা উৎপাদনের মেশিনের মত মহামারিতেও আয়ের পথে অটল, তাদের সম্ভব কি করোনার প্রলঙ্কারী আঘাত মোকাবেলা করা? যে আঘাত সামলাতে পারেনি চীন, ইতালি, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো মোড়লরা! সেখানে মৃত্যুর মিছিল চলছে। এত কিছু দেখার পরও আমরা সম্মুখ উপস্থিতিকে আহ্লাদে বুকে টেনে নেই। মোসাহবিদা করি।
করোনা মোকাবেলায় প্রথম ও প্রধান যে নির্দেশনা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা যখন কেউ মানছি না, তখনই লাঠি হাতে তুলে নিতে হয় পুলিশকে।
গরিবদের জন্য সরকারের বরাদ্দের চাল চুরিতে যখন জনপ্রতিনিধিরা মত্ত, ঠিক তখন রাজধানীর জিরো পয়েন্ট থেকে অজপাড়া গাঁয়ের প্রায় ১৭ কোটি মানুষকে সামাজিক দূরত্ব শিখাতে ব্যস্ত এই পুলিশ। প্রসববেদনায় রাস্তায় পড়ে ছটফট করতে থাকা নারীর কষ্টের বিষয়টি অনুধাবন করে এগিয়ে আসেন পুলিশ সদস্যরা নারায়ণগঞ্জে গিটারিস্ট হিরো লিসানের লাশ রাস্তায় পড়ে থাকার খবরটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিউজ ফিডে ঘুরে ফিরে আসছে। ঠান্ডা, জ্বর, শ্বাসকষ্টে ৭ এপ্রিল ভোররাতে হিরোর মৃত্যু হয়। ভোরেই হিরোর বাড়ি দেওভোগ কৃষ্ণচূড়া এলাকা থেকে মরদেহ একটি এ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়ার সময় এলাকাবাসী বাধার মুখে চালক মরদেহ ফেলে রেখে চলে যায়। এসময় পরিবারের লোকও কাছে আসেনি। পরে পুলিশ খবর পেয়ে মরদেহটিকে দাফন করে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কয়েকটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। রাজধানীর তালতলা কবরস্থানে পুলিশ সদস্যরা কবর খুঁড়ছেন। তারাই জানাজা পড়ছেন। তারাই দাফন করছেন। করোনাভাইরাসে মৃত ব্যক্তির লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর না করে প্রশাসন থেকেই দাফন করা হচ্ছে। বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন অনুযায়ী আইইডিসিআর বিষয়টির তত্ত্বাবধান করছে।
এখন পুলিশের উদারতার এমন হাজারো ঘটনা মিলছে। এইসব ঘটনা একটি বিষয় চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমরা কি একটু বেশি অমানবিক আচরণ করছি না। হার্ট এ্যাটাকের রোগীর তো শ্বাসকষ্ট হতেই পারে। তাই বলে কি তার সাহায্যে কারও এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল না! আবার দক্ষিণখানের করোনাআক্রান্ত যুবকের কি উচিত হয়েছে পালিয়ে যাওয়া। তিনি তো আরও বহু মানুষের মধ্যে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে পারেন। এতদিন যারা পুলিশকে বলে এসেছেন আপনারা তো মানুষ নয় পুলিশ। বাক্যটি শুনতে কেমন গালির মতো শোনালেও সেই পুলিশই এখন দিন রাত মানুষের সেবা করছে। অমানবিক মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে মানবিক পুলিশ। সময়ের বৈরিতাকে যিনি ভয় না পেয়ে সেবার হাত প্রসারিত করেন তিনিই আসলে মানবিক।ক্রান্তিকালে বিপদগ্রস্থ মানুষের শিক্ষক, ঘরের বাজার করার ছেলে, ওষুধ কিনে দেওয়ার লোক, লাশ দাফনের মোতয়াল্লি, ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার পরও কি মনে হয় পুলিশ শুধু পুলিশ আছে? পুলিশ দেখলে কি এখনো গালি আসে?
রাষ্ট্রের প্রয়োগিত স্তম্ভ হচ্ছে শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এসব বাহিনীর মধ্যে নৌ, স্থল ও আকাশ পথ প্রতিরক্ষায় আলাদা আলাদা ইউনিট রয়েছে। আর কোটি কোটি মানুষের হ-য-ব-র-ল সিস্টেমটাকে আয়ত্বে রেখে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অভিপ্সা আইন বাস্তবায়নে কাজ করে পুলিশ। ফলে পুলিশ সর্বত্র-সামগ্রিক শৃঙ্খল। কোটি মানুষের সাথে চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করায় ভুল-ত্রুটিও ব্যক্তিবিশেষে ধরা পড়ে।
৮ মার্চ যখন বাংলাদেশ করোনাক্রান্ত হলো, সেদিন থেকে মানুষের মধ্যে চাপা আতঙ্ক দানা বাঁধতে শুরু করে। কি জানি কী হয়? সরকার ঘোষণা দিলো সকল মানুষকে ঘরে ফেরার জন্য। সমাগম ত্যাগ করে ঘরে থাকতে শুরু হলো কাউন্সেলিং। মানুষ কিন্তু তখনও তামাশা ভেবে নির্দেশনাগুলো উড়িয়ে দিচ্ছিল।
একটি রাষ্ট্রের হাতেগোনা যে কয়টি নিয়ামক বিপদগ্রস্ত অবস্থায় সবোর্চ্চ ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে থাকে সেই স্তম্ভগুলো কিন্তু সেই দুর্দিনে ঝাঁপিয়ে পড়লো। ডাক্তার, পুলিশ এবং সাংবাদিক। ডাক্তার এবং পুলিশ রাষ্ট্রের প্রথম স্তম্ভের অংশ। তার সাথে জুড়ে বসে তৃতীয় চোখ গণমাধ্যম। করোনা যুদ্ধেও কিন্তু দ্বিতীয় চোখ অর্থাৎ রাজনীতিবিদদের পিছপায়ের নিদর্শন পূর্বের মহাক্রান্তির মতই। ফলে সমন্বয় করতে হচ্ছে উপকারইচ্ছুদের নিয়েই। তবে তর্ক আছে আমাদের ডাক্তারদের মনোবাসনা নিয়েও। কভিড-১৯ দেশে আমদানি হওয়ার পর মানব শরীর ঘেঁটে মিলিয়ন মিলিয়ন টাকা ডিপোজিটকারীদের কেউ কেউ আনাগ্রহ দেখালেন চিকিৎসা দিতে। কেউ কেউ দিলেন চাকরি ছাড়ার আবেদন। কর্মবিরতি পালন, অতঃপর ব্যক্তিগত বা বেসরকারি চেম্বার থেকে উধাও ডাক্তার। ভারত যে ডাক্তারকে করোনা যুদ্ধে ‘সাক্ষাৎ ইশ্বর’ বলে অভিহিত করছে; বাংলাদেশে তা কি আমরা পারছি?
কিন্তু এই করোনা মোকাবেলার ঘোষণা দেওয়ার পর একমাস অতিক্রম করলো দেশ। এরমধ্যে কতজন পুলিশ চাকরি ছাড়ার আবেদন করেছেন? তাদের কি মৃত্যুর ভয় নেই? তাদের ঘরে কি সন্তান-সন্তদি নেই? পুলিশ কি মাটিতে তৈরি যে তাকে করোনা আক্রমণ করবে না? এসবই মিথ্যে। করোনা রোগীর সংস্পর্শে এলে পুলিশ আক্রান্ত হবে। ছেড়ে দেবে না। তারও হৃদয় কাঁদে মা, স্ত্রী, সন্তান, স্বজনদের জন্য। পুলিশও নিরাপত্তাহীনতায় শতভাগ। তারপরও সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে আপনাকে-আমাকে, আমাদের পরিবারকে বাঁচাতে তারা করোনার সাম্রাজ্যে নেমেই কাজ করছে। এটাকে চাকরি বলে? না দেশপ্রেম। এর মধ্যেই ২১৮ জন পুলিশ সদস্য করোনা আক্রান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশের সদর দপ্তর।ইতিমধ্যে সংবাদকর্মীরা আক্রান্ত হয়েছেন।
পুলিশের কাছে সাহায্য চেয়ে পায়নি এমন দৃষ্টান্ত নেহাৎ নেই বললেই চলে। বাপ মারা যাওয়ার পর ছেলে পালিয়ে গেলেও সেই লাশ কাঁধে নিয়ে ধর্মীয় রীতি মেনে শেষ বিদায় জানাচ্ছে পুলিশ।
ঘরবন্দী মানুষ যখন টিভিতে একই ঘটনার সংবাদ, একই সিরিয়াল, একই আলোচনা শুনে হাঁপিয়ে উঠছে, পুলিশ তখন সাউন্ড বক্স, বাদ্যযন্ত্র নিয়ে মহল্লায় মহল্লায় গান করে, হাস্যরস জুগিয়ে মানুষের ক্লান্তি ঘোচাচ্ছে। আর চব্বিশ ঘণ্টা সড়কে, মানুষের বাড়ি; আনাচে-কানাচে নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে মানুষ সতর্ক করে বেড়াচ্ছে। এত কিছু কেন তাকে করতে হবে? যে বেতন পান তাতে কি এসব করতে বাধ্য পুলিশ?
করোনায় কিছু জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠান বাদে সব সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার পরেও সাধারণ মানুষ ঘরে থাকা বাদ দিয়ে পাড়ায় বাড়ি বাড়ি আড্ডার পসরা সাজাচ্ছে নিয়মিত। শিক্ষার্থীরাও পাশাপাশি বসে আড্ডা না দিলেও চুপ করে মোবাইল গেমস্ খেলে যাচ্ছে, যাদের অধিকাংশেরই মুখে মাস্ক থাকে না।
এই খামখেয়ালীপনায় ইতোমধ্যে কড়ায় গণ্ডায় আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই যাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতেও মানুষের উদাসীনতা ও উৎসুক প্রবণ মন মানসিকতা কতটা ভয়াবহ অবস্থার দিকে নিচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়। সামাজিক সংক্রমণের পথে করোনা। কৌতূহল ও উদাসীনতা দূর করতে না পারলে চারদিকের সকল প্রতিরোধ ও পদক্ষেপ বিফলে যাবে। প্রতিদিন গুণতে হবে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা।
জানাযা ফরজে কেফয়া। আমাদের যে পরিস্থিতিতে ফরজ নামাজই সচেতন আলেমরা ঘরে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন সেখানে জানাজ? বাঙালি মুসলমানদের ইসলাম বিদ্বেষীদের কথা মাথায় রেখে হলেও সচেতন হওয়া দরকার। এখনো সময় আছে, চলুন সচেতন হই। ঘরে থাকি। নিরাপদে থাকি। সবাইকে ভালো রাখি।
লেখক: আফছানা রহমান, বার্তা সম্পাদক সিএনএন বিডি,টিভি।