বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
তোফায়েল আহম্মেদ, নিজস্ব প্রতিনিধি : ১৫ বছরে হত্যা, নির্যাতন, গুম-খুন ও দেশের মানুষের কণ্ঠরোধ করে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার ছয় মাস পূর্তি আজ। আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জুলাই-আগস্টের হত্যা মামলায় প্রধান আসামি হিসেবে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হলেও কোনো অগ্রগতি নেই।
যেভাবে স্বৈরাচারের মসনদ তৈরি করেন শেখ হাসিনা
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন শেখ হাসিনা। নানা আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে মইন ইউ আহমেদ ও ফখরুদ্দিনের কাঁধে ভর করে মসনদে বসেন তিনি। তারপর থেকেই খুলে ফেলেন তার নতুন মুখোশ। শুরু করেন বিরোধীদল ও মতকে দমন। এতে ব্যবহার করেন বিচার বিভাগকে। একইসঙ্গে রাজপথের আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে দিয়ে বল প্রয়োগ, মামলা, হামলা, গুম, হত্যার পথ বেছে নেন তিনি। ২০১৪ সালে বিনা ভোটে গদি টিকিয়ে রাখেন শেখ হাসিনা। ২০১৮ সালে দিনের ভোট করেন রাতে। প্রশাসনের সব স্তরকে ব্যবহার করে ভোট জালিয়াতি, ভোট ডাকাতি ও মরা ব্যক্তির ভোটে ক্ষমতায় এলেও ২০২৪ সালের নির্বাচন খ্যাতি পায় ডামি নির্বাচন নামে। এভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে অবস্থান টিকিয়ে রাখা শেখ হাসিনা হয়ে ওঠেন একগুঁয়েমি, বেপরোয়া, অহঙ্কারী, হিংস্র ‘ওয়ানম্যান আর্মি। এই অহঙ্কারের আগুনে পুড়ে অবমূল্যায়িত হন দলীয় জ্যেষ্ঠ নেতারাও।
যদিও ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির ডামি নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার বেপরোয়া একগুঁয়েমিতাই তার জন্য হয়ে ওঠে কাল। সাত মাস পূর্তির আগেই পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তিনি। তবে, জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দলীয় কর্মীদের ব্যবহার, বাহিনীকে দিয়ে হত্যা-দমনের মাধ্যমে ক্ষমতা আকড়ে পড়ে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন তিনি, তারপরও হয়নি শেষ রক্ষা!
শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বের এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তার হিংস্রতার বিশদ বর্ণনা উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায়।
গত ১৭ অক্টোবর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনের চেষ্টায় গণহত্যার দুই অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তন্মধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে পৃথক একটি মামলা এবং ওবায়দুল কাদেরসহ অন্যদের বিরুদ্ধে পৃথক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গত ১৫ বছরে সেনাবাহিনীকে ধ্বংসে পিলখানা হত্যাকাণ্ড, পিতৃহত্যার প্রতিশোধে ছিলেন মরিয়া, ভিন্ন মত দমন, ট্রাইবুনাল,,জামায়াত দমনে প্রোপাগান্ডা, গণজাগরণ মঞ্চ ব্যবহার, ইসলামি চেতনা দমন, রিজার্ভ চুরি, সাগর-রুনিসহ সাবাদিকদের হত্যা, প্রধান বিচারপতিকে, অপসারণ, ২০১৪ সালে এক তরফা নির্বাচন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে রাতের কাণ্ড, ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচন, নির্বাচনের আগে সাজা দিয়ে খালেদা জিয়াকে কারাগারে প্রেরণ, ভয়ভীতি, গুম-খুনের রাজনীতি, জুলাই-আগস্টে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়।
যেভাবে পতন আসে শেখ হাসিনার
কোটাবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর জুলাই-আগস্টে গণহত্যা চালানো হয়। রংপুরে আবু সাঈদকে সরাসরি গুলি করে হত্যা করা হয়। যে ভিডিও দেখে সারা বিশ্বের মানুষ কেঁদেছে। হত্যাকাণ্ডের পরিণতি এত ভয়াবহ ছিল মানুষ এখনও আঁতকে ওঠে। এ হত্যাযজ্ঞ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা এতটা নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছে যে, ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে ছাই করে ফেলে। ছাত্র-জনতাকে হত্যার পর এপিসোড গাড়ি থেকে ফেলে দেওয়া হয়। এ ছাড়া সামনে দাঁড় করিয়ে বুকে মাথায় গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়। আন্দোলন কেন্দ্রিক হাজারও ছাত্র-জনতাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়।
পতন তরান্বিত
দেশের ভেতরে আওয়ামী লীগ একা হয়ে পড়েছিল। দীর্ঘ শাসনে সবাইকে খেপিয়ে তুলেছিলেন শেখ হাসিনা। তাঁর সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ও অর্থনীতির মন্দা পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। আর রাজনৈতিক দিক থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের বাইরে অন্য সব দল সরকারবিরোধী অবস্থানে চলে যায়। এর ফলে শেখ হাসিনা রাজনৈতিক দিক থেকেও একা হয়ে পড়েন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনেও সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে ভূ-রাজনীতিতে শেখ হাসিনার সরকার ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পরপর তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন করেও টিকে থাকে। এই আলোচনা চলছিল অনেক দিন ধরে। সরকার চীনের সঙ্গেও একটা সম্পর্ক রেখে চলছিল। গত জুলাই মাসেই ৭ তারিখ থেকে দুই দিন চীন সফর করেছিলেন শেখ হাসিনা। সর্বশেষ সেই সফরে অবশ্য ভালো ফল হয়নি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল অনেক দিন ধরে। বিভিন্ন সময় শেখ হাসিনাসহ তাঁর নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করেন। সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন বেড়ে যায়। তবে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ দেশের মানুষ ও শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলে। এতে একেবারে একা হয়ে পড়েন তিনি ও তার সরকার।
শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার লড়াই, অবশেষে পলায়ন
শেখ হাসিনার পলায়নের ৩৬ দিন আগে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে মাঠে নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু শেখ হাসিনার একগুয়েমি, অহঙ্কার আর প্রতিশোধ পরায়ণতা শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি পর্যবেক্ষণ থেকে দূরে রেখেছিল। এমনকি, তিনি ছাত্রছাত্রীদের দমনে তাদের পেছনে লেলিয়ে দেন তার প্রশাসনকে। নামিয়ে দেন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সহযোগী সংগঠনগুলোকে। কিন্তু তাতে সারা দেশে সংঘাত–সংঘর্ষে শত শত জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এরপরও শক্ত হাতে দমনের কথা বলা হয়।
জানা যায়, পতনের আগের দিন ৪ আগস্ট রোববার সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গণভবনে বসে শেখ হাসিনা তাঁর সরকারের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন মন্ত্রী ও কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতা জানিয়েছেন, রোববারও সরকারের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। এরপরও পরিস্থিতি তাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে তাঁরা ধারণা করেছিলেন। কিন্তু চাপ আরও বাড়তে থাকে। গতকাল সকালেই তাঁরা বুঝতে পারেন, তাঁদের সময় শেষ হয়ে গেছে। এরপর শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ৫ আগস্ট পালিয়ে যান ভারতে। যদিও ক্ষমতা ছেড়ে গেলেও প্রতিশোধের আগুনে তারই পেটোয়া বাহিনী পুলিশের হাতে তখনও জীবন দেন আরও অনেককে।
ভারত ছাড়া আশ্রয় মেলেনি কোথাও
এক সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘ভারতকে যা দিয়েছি সেটি তারা সারা জীবন মনে রাখবে।’ এর আগেপরে তার ভারতপ্রীতি নিয়ে ছিল আলোচনা, সমালোচনা, অভিযোগও। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ ভারতেই আশ্রয় নেওয়ার পর এটি ফের সামনে আসে। পরে জানা যায়, গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে অন্তত ২০টি চুক্তি ও ৬৬টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। অন্তবর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দাবি, এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের অধিকাংশতেই উপেক্ষিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বার্থ। এভাবেই তিনি সেখানে থেকে গেছেন। যদিও যুক্তরাজ্যে যেতে চেয়েছিলেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর চাউর হয়। তবে, সেখানের তথ্য বলছে, দেশটি তাঁকে নিতে রাজি হয়নি। পরে দুবাইয়ের নামও আসে তালিকায়। বিভিন্ন সূত্রের তথ্য, আরব আমিরাতের এই রাজ্যটিও শেখ হাসিনাকে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
দিগ্বিদিক পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আ.লীগের কর্মীরা, শীর্ষ নেতাদের প্রতি ক্ষোভ
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে টানা ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে দলটির নেতাকর্মীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গত বছরের ৫ আগস্ট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে সামরিক হেলিকপ্টারে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করেন দলটির শীর্ষ নেতারা। তাদের মধ্যে অনেকে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে গেছেন। কেউ কেউ আবার পালানোর সময় বিমানবন্দরে এবং আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। তবে দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীদের দিন কাটছে গ্রেপ্তার আতঙ্কে। বিচ্ছিন্নভাবে তারা আত্মগোপনে থেকে গ্রেপ্তার এড়াতে চেষ্টা করছেন। তাদের অনেকে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ভুল সিদ্ধান্ত ও অদূরদর্শিতাকে দায়ী করে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করছেন
আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা বিদেশে অবস্থান ও আত্মগোপনে থাকায় গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা দলটিতে দেখা দিয়েছে চরম নেতৃত্ব শূন্যতা। সাংগঠনিকভাবে দলটি রীতিমতো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। দেশজুড়ে দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, চাঁদাবাজি, দখল, গুম-খুন এবং গণহত্যাসহ নানা অপরাধে মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে আদালতের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও বিচার প্রক্রিয়া চলছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন মামলায় দলটির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে।
দিন যত যাচ্ছে আওয়ামী লীগের জন্য সংকট আরও গভীর হচ্ছে। সংকট থেকে উত্তরণে আওয়ামী লীগের চেষ্টার মধ্যে তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভেরিফায়েড পেজগুলো থেকে বিভিন্ন অসঙ্গতি তুলে ধরে পোস্ট করতে দেখা গেছে। এ ছাড়া কেউ কেউ আবার ছোটখাটো ঝটিকা মিছিল, দেয়াল লিখন করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হচ্ছেন।
গত সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, যারা আওয়ামী লীগের লিফলেট বিতরণ করবে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। তিনি বলেন, ‘পতিত স্বৈরাচারের দোসর ও সাঙ্গপাঙ্গরা অনেক কিছু করতে চাচ্ছে। তারা লিফলেট বিতরণ করতে চাচ্ছে। যারা লিফলেট বিতরণ করবে তাদের জন্য কড়া বার্তা হলো—তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।’
এর আগে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে। আর উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ইতোমধ্যে বলেছেন, আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হবে না। এমন পরিস্থিতিতে দিশেহারা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এখন দিগ্বিদিক ছুটছেন।
ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের দল এখন বিপর্যস্ত, নেতাকর্মীরা দিশেহারা। ছয়মাস কেটে গেলেও কেন্দ্র থেকে কার্যকর কোনো নির্দেশনা এখনও আসেনি।
মোবাইলফোনেও কেউকে পাওয়া যাচ্ছে না। হামলা-মামলা সব মিলিয়ে নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন।’ বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের দায়ী করছেন তৃণমূলের এই নেতা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের মধ্যম সারির এক নেতা বলেন, ‘ছয় মাস হয়ে গেল আমরা বাড়ি-ঘরে যেতে পারছি না, পরিবার-পরিজন নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কবে এলাকায় ফিরতে পারব, তা-ও জানি না। এলাকায় একটা বাজারে আমার দুটো দোকান ও একটা স’মিল আছে, যা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। কিন্তু, সবই দখল হয়ে গেছে। পরিবার নিয়ে সামনে কীভাবে চলব, কোথায় দাঁড়াব, সেটা নিয়েই চিন্তায় আছি।’
ঢাকায় আশ্রয় নেওয়া ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের আরেকজন কর্মী বলেন, ‘আমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছি, কাজকর্ম করব কী করে? আয় না থাকলে সংসারের কী অবস্থা হয়, তা তো বুঝতেই পারছেন। টাকা-পয়সা যা বাড়িতে রেখে এসেছিলাম, সব ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। এখন বাজার করার মতো অবস্থাও নেই। ঘরে ছোট দুটো ছেলে, তারা কী খাবে? মোবাইলফোনে আমার স্ত্রী প্রতিদিন কান্নাকাটি করে। কিন্তু এভাবে কতদিন থাকবে? ভাবতে গেলেই কান্না আসে। মনে হচ্ছে, রাজনীতি করাই পাপ হয়েছে। তাই আর রাজনীতি করব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
আওয়ামী লীগের কর্মীদের মধ্যে আরও অনেকেই এমন সিদ্ধান্তের দিকে এগোচ্ছেন বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের এক নেতা। খুলনা মহানগরের আওয়ামী লগের একজন নেতা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ক্ষমতা হারালে এমন অবস্থা যে হতে পারে, সেটাতো নেতাদের অজানা থাকার কথা না। তারাইতো এ অবস্থার জন্য দায়ী। ক্রিম খাইলো নেতারা, কোটি কোটি টাকা বানাইলো তারা, আর তাদের পাপের শাস্তি ভোগ করতে হইতেছে আমাদের মতো তৃণমূলের নেতাকর্মীদের।’
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের একজন কর্মী বলেন, ‘আগস্টে গা ঢাকা দেওয়ার পর ডিসেম্বরে এলাকায় ফিরেছিলেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় এখন তারা আতঙ্কিত। ফলে আবারও ঘর ছেড়েছেন।’
রাজধানীর মিরপুর থানা আওয়ামী লীগের একজন কর্মী পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের কমিটি আন্দোলনের আগে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। আমরাতো ঝামেলায় ছিলাম না। যেভাবে অভিযান চলতেছে, তাতে বাসায় থাকতে পারতেছি না।’
বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেত্রী সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘আমার আসলে যাওয়ার জায়গা নেই। আমি কিছুই করি নাই। কারও দুই টাকা খাই নাই, কাউকে মারিও নাই। এটা সবাই জানে। আমি আমার বাসায় আছি, কিন্তু আতঙ্ক আছি।’
আতঙ্ক বিরাজ করছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের মধ্যেও। ইতোমধ্যে জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই দেশ ছেড়েছেন। তবে পালানোর সুযোগ না পেয়ে দেশে রয়ে গেছেন যে কাউন্সিলররা, তারা আতঙ্কে আছেন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের এক সমর্থক বলেন, ‘আমার কোনো পদ নেই। মারামারিতেও ছিলাম না, কিন্তু আমার নামে মামলা দিয়েছে। কয়েকদিন বাসায় থাকলেও এখন আর পারছি না।’
দলীয় সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রেপ্তার এড়াতে এক জেলার নেতারা আরেক জেলায় অবস্থান করছেন। তাদের মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা ঢাকায় রয়েছেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের একজন আত্মীয় এবং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নিজ এলাকা ছেড়ে ঢাকায় অবস্থান করছেন। তিনি বলেন, এলাকায় ফেরার কোনো উপায় নেই। প্রতিদিনই পুলিশ বাড়িতে হানা দিচ্ছে। এ ছাড়া সম্প্রতি ওবায়দুল কাদেরের এক ভগ্নিপতিকে প্রকাশ্যে মারধর করা হয়েছে। এতে তারা এলাকায় ফেরার সাহস পাচ্ছেন না।
গভীর সংকটে পড়া ঐতিহ্যবাহী দলটির কেন্দ্র থেকে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত পুরো সংগঠন অকেজো হয়ে পড়েছে। প্রকাশ্যে কোনো তৎপরতা নেই। এমনকি, নেতাদের পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনাও পাচ্ছেন না কর্মীরা। এতে ক্ষোভ রয়েছে অনেকের মধ্যে।
বিপর্যয় কাটিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়াতে দেশ-বিদেশে আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীদের মধ্যে গত কয়েক মাসে যোগাযোগের একটি নেটওয়ার্ক তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। তারা অন্তত ভার্চুয়ালি সক্রিয় থাকার চেষ্টা করছেন। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ কয়েকটি ইস্যুতে চলতি মাসে বেশ কয়েকটি কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তবে, এ নিয়ে দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।