ইজ্জত দিয়ে দেশ স্বাধীন করলাম অথচ ছি ছি করে সমাজ,এইডা কেমন বিচার?
বুধবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫
ফিরোজা বেগম
শাহিনুর আক্তার, স্টাফ রিপোর্টার: মাত্র দশ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল ফিরোজা বেগমের। গ্রাম থেকে বেশ দূরে, মাদারীপুরের তরকীতে ছিল শ্বশুরবাড়ি।
স্বামী চাষবাস করতেন। বিলের ধারের বাড়িতে স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখেই কাটছিল তাদের দিন। মুক্তিযুদ্ধের আগেই তাদের কোলজুড়ে আসে প্রথম সন্তান। কিন্তু একাত্তরের কালরাত্রি সেই সুখ সইবে কেন?
ফিরোজা বেগমের জবানিতেই উঠে আসে সেই সুখস্মৃতি ও তার করুণ পরিণতির কথা, স্বাধীনের আগেই একটা পোলা হইছিল। স্বামী-সন্তান নিয়া সুখেই দিন কাটত। দেশে যহন যুদ্ধ হয় তহন কোলের ছেলেডার বয়স ৬ মাস। গুটি গুটি পায়ে হাঁটে। আমারও প্রাণ জুড়ায়া যায়।
কিন্তু যুদ্ধের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে। পাকিস্তানি সেনারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে শুরু করে। জীবন বাঁচাতে মানুষ দিগ্বিদিক পালাতে থাকে। ফিরোজা বেগমের বাড়িতেও আগুন দেয় তারা। প্রথমে এক বাড়িতে আশ্রয় নিলেও, পরে মিলিটারির আসার খবরে মামাবাড়ির দিকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেন তারা। আর ঠিক তখনই যমদূতের মতো হাজির হয় পাকিস্তানি সেনা। ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থেকেও শেষ রক্ষা হয়নি। কোলের ছয় মাসের শিশুটিই কাল হয়ে দাঁড়ায় নরপিশাচদের কাছে।
ফিরোজা বেগম বলেন, “ওরা আইসা প্রথম কোল থিকা ওরে ছাড়াইয়া নেয়। ভয়ে ও চিৎকার দিয়ে কাঁদতে থাকে। ওরা নিয়াই দুইজন হাত দিয়া টাইনাই ছিঁইড়া ফালাইছে আমার পোলাডারে। এরপর তারে মেলা মাইরা ফেলাইয়া দিছে। ওর তখন আর দম নাই। কান্নার শব্দও নাই। রক্তাক্ত ও নিথর শরীরডা পইরা ছিল মাটিতে। আর সহ্য করতে পারলাম না। একটা চিল্লানি দিয়া উঠলাম আমি। চোখের সামনে এভাবেই কোলের পোলাডারে পাক বাহিনী মাইরা ফালায়। ওই শিশুডার কি দোষ ছিল বলেন? পাকিস্তানিরা না মুসলমান? কোলের পোলাডারে যে ওরা মারলো এইডা কি ধর্মে আছে? এই বিচার আল্লাহর কাছে দিয়া রাখছি ভাই।
মাদারীপুরের হযরতপুর গ্রামের মোতালেব গোড়ামী আর মরিয়ম বেগমের বড় সন্তান ফিরোজা। একাত্তরের সেই বিভীষিকাময় দিনে চোখের সামনে কোলের সন্তানকে হত্যার পর ফিরোজার ওপর নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন। সেই নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে শিউরে ওঠেন তিনি।
বাচ্চাডারে মারছে ওরা। আমাকে ‘আ’ করতেও দেয় নাই। একজন বুকের ওপর পাড়া দিছে। আরেকজন মুখে গামছা ভরে দিছে। আমি ‘আ’ কইরা চিইক্করও দিতে পারি নাই! বাবারে বইলাই পাগলের মতো হয়ে যাই। এরপরই জ্ঞান হারাইছি। যহন জ্ঞান হইল দেখলাম চোখ বান্ধা। কই লইয়া আইছে টের পাই নাই। চোখ খোলার পর দেখলাম অনেকগুলা মেয়েমানুষ। কয়েকজন বয়স্কও আছে। তারপর আটকা রইলাম অনেক দিন। অনেক হেস্তনেস্ত করল। কানতে কানতে বুক ভাসাইলাম। তবুও শরীরডার ওপর নির্যাতন চলল।
ফিরোজাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় যশোরের শার্শার বাগআঁচড়া গ্রামের ক্যাম্পে। সেখানে দিনের পর দিন চলে পাশবিক নির্যাতন। সেই ক্যাম্পের ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, একটা ঘরের মধ্যে নিয়া রাখল। এরপর সৈনিকগো দিয়া নির্যাতন করাইছে। একজন যায় আরেকজন আসে। আমগো মাথার চুল কাইট্টা ফেলছিল। কেউ যেন ফাঁস দিয়া মরতে না পারে সেইজন্য শরীরেও কোনো কাপড় রাখে নাই। নির্যাতন সহ্য করতে না পাইরা বেহুঁশ হইয়া যাইতাম। তবুও আর্মিরা নির্যাতন করত। খাবার একদিন দিলে তিনদিন দেয় নাই। পাকবাহিনী তো বাঙালিগো মানুষ মনে করত না। একশোর ওপর নারী ছিল ওই ক্যাম্পে। পানি চাইলে প্রস্রাব করে খেতে দিতো। পাকিস্তানি আর্মি তো মানুষ ছিল না ভাই। ওদের কথা মনে হলেই ঘেন্না করি।
পরবর্তীতে হেমায়েত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা সেই ক্যাম্পে আক্রমণ করে ফিরোজাসহ আটক নারীদের উদ্ধার করেন। উদ্ধারের সময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন ফিরোজা। আরেক বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা শেখ ফাতেমা আলী তাকে চিকিৎসা ও সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। ট্রমায় নিজের নাম-পরিচয় ভুলে যাওয়া ফিরোজা ধীরে ধীরে স্মৃতি ফিরে পান। কিন্তু স্বাধীন দেশে কেমন কাটছে মুক্তিযোদ্ধা ফিরোজা বেগমের জীবন? এমন প্রশ্নে তিনি আনমনা হয়ে যান।
স্বামীরে তো খুঁইজা পাই নাই। পরে একজনের সঙ্গে নতুন সংসার করছি। সেও এহন মইরা গেছে। মাইনষের বাড়িত কাম করতাম। নিজেরে কখনও বীরাঙ্গনা পরিচয় দিতে পারতাম না। লজ্জায় বলতেও পারি নাই। এহন সরকার স্বীকৃতি দিছে। ভাতাও পাই। ওটা দিয়াই পরিবার চলে, বাঁইচাও আছি। এহনও বীরাঙ্গনার পরিচয় জানলে কেউ সম্মান করে। কেউ আবার আগে পিছে খারাপ কথা বলে। ছি ছিও করে।
মাইয়াডারে বিয়া দিলাম প্রথম। অনেক পরে জামাই জানতে পারছে আমি বীরাঙ্গনা। মাইয়াডারে ৩ সন্তানের লগে দিয়া ছাইড়া দিছে। স্বাধীনতার জন্য নির্যাতিত হওয়াও কি অপরাধ? আমরা তাহলে কী করমু? আমগো নির্যাতন করছে পাকিস্তান বাহিনী। ওগো কেউ ঘৃণা করে না। ওরা ভালা। আর দেশের জন্য নির্যাতিত হয়ে যেই স্বাধীন দেশ আনলাম সেই দেশের মানুষই এহনও আমগো ছি ছি করছে। এইডা কেমন বিচার? কেমন কৃতজ্ঞতা?
ফিরোজা বেগম একাত্তরের নির্যাতিতা, গ্লানি ঢাকতে যাকে আমরা ‘বীরাঙ্গনা’ বলি। পাকিস্তানি সেনারা একাত্তরে তার কোলের সন্তানকে কেড়ে নিয়ে হত্যা করেছে, তার ওপর চালিয়েছে নিদারুণ শারীরিক নির্যাতন। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর বদলে যেতে থাকে অনেক কিছু। আমরাও ভুলে যেতে বসেছি আমাদের শেকড়ের ও আত্মত্যাগের ইতিহাস।
এ কারণেই মুক্তিযোদ্ধা ফিরোজা বেগমের মতো নারীদের একাত্তরের ঘটনা আজও ‘কলঙ্কের দাগ’ হয়ে যন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছে। এমন বাংলাদেশের স্বপ্ন কি আমরা দেখেছিলাম?