নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই পাবনায় ৩শ অবৈধ ইটভাটায় পুড়ছে২ হাজার ৮শ মেট্রিকটন কাঠ!
বৃহস্পতিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২২
মোঃ মোবারক বিশ্বাস, পাবনা: পাবনায় পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়াই অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে প্রায় ৩ শতাধিক ইটভাটা। এসব অবৈধ ইটভাটায় কাঠ পোড়ানোসহ নারী ও শিশু শ্রমিকদের স্বল্প মুজুরীতে কাজ করানো হয়।
বেশিরভাগ ইটভাটায় স্থাপন করা হয়েছে অবৈধ কাঠ কাটার স মিলস। অবৈধ ইটভাটায়, বৃক্ষ নিধন করে কাঠ জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করায় পরিবেশের উপর বিরুপ প্রভাব পড়ছে। অবৈধ ইটভাটার কারনে সরকার বিপুল পরিমান রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হলেও সরকারী কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের পকেট ভারি হচ্ছে। পদ্মা নদীর কোল ঘেষে জেলার ঈশ^রদী উপজেলা থেকে সুজানগর উপজেলার প্রায় ৫০ কিলো মিটারের মধ্যে বেশিরভাগ ইট ভাটা স্থাপন করা হয়েছে। ঈশ^রদী উপজেলার লক্ষিকুন্ডা ইউনিয়নে রয়েছে ৫২টি ভাটা ।
পাবনায় নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়াপত্র ছাড়ায় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না নিয়েই যত্রতত্র গড়ে উঠেছে অবৈধ ইটভাটা। পাবনার প্রায় ৫০টি ইটভাটার ১শ থেকে ৩শ গজ দুরত্বের মধ্যে স্কুল, কলেজসহ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে। ভাটার আশ পাশে ঘরবাড়ি ও ফসলিজমিসহ নানা স্থাপনা রয়েছে। ইট ভাটার ধোয়া ও ধুলাবালির কারনে আশেপাশের বাসিন্দাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে শ^াসকষ্টসহ নানাবিধ অসুখ। এদিকে ইঁটভাটায় মাটি ও ইট আনা নেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে ভারী যানবাহন। এসব যানাবহন চলাচলের কারনে রাস্তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং ধুলাবালি উড়ে রাস্তারপাশে বসবাসকারীদের বাড়িঘর ধুলোয় ভরে যাচ্ছে। এসব বাসিন্দারা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ফলজ গাছগুলোতে ধোয়া ও ধুুলির কারনে ফলমুল নষ্ট হচ্ছে ফলে ফলজ ও বনজ গাছগুলো কেটে ইট ভাটার জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অতিরিক্ত ধোয়া ও গাছ কাটার ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বনডাই অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে জানান পরিবেশবিদগণ। প্রতিদিন প্রতিটি ভাটায় ৩শ থেকে ৫শ মন কাঠ পোড়ানো হয়। এতে করে ভাটাগুলোতে প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার ৮শ মেট্রিকটন কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। বেশিরভাগ ভাটায় স্থাপন করা হয়েছে কাঠ কাটার জন্য স মিলস। এ অবস্থা চলতে থাকলে খুব অচিরেই পাবনা বিরানভুমি হিসাবে প্রকাশ পাবে। ভাটার আশে পাশে ফসলি জমিতে ধুলাবলির কারনে ফসল উৎপাদন একেবারেই কমে গেছে। বাধ্য হয়ে জমির মালিকেরা ইট ভাটার কাছে জমি ইজারা দিতে বাধ্য হচ্ছে। এসব অবৈধ ভাটায় মাটির চাহিদা পুরন করতে জেলার বিভিন্ন স্থানে ফসলি জমি খনন করে তা সরবরাহ করা হচ্ছে। এমনকি পদ্মা নদীর তীরে ভুমিদস্যুরা ভেকু মেশিন দিয়ে মাটি কেটে তা ইট ভাটায় সরবরাহ করে থাকে। ইটভাটাগুলোতে নারী শ্রমিকসহ শিশু শ্রমিকদের স্বল্প বেতনে কাজ করানো হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশিরভাগ ইটভাটার মালিক ও ম্যানেজার জানান, প্রতিটি ইটভাটা থেকে জেলা প্রশাসক বছরে ২বার এক ট্রাক করে ইট নিয়ে থাকেন। (এক ট্রাকে ১৪ হাজার ইট বোঝাই করা হয়, যার বর্তমান বাজার মুল্য এক লাখ ১২ হাজার টাকা) ফলে এসব ইটভাটা থেকে জেলা প্রশাসক কার্যালয় বছরে কয়েক কোটি টাকা উৎকোচ গ্রহন করে থাকে। এছাড়া উপজেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সরকারী দফতর, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাসহ বিভিন্ন পেশায় জড়িতরা নিয়মিত মাসোহারা নিয়ে থাকেন এসব ইটভাটা থেকে। একারনে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা এসব ইট ভাটা নির্বিঘেœ তাদের কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রশাসনের লোকজন মাঝে মধ্যে ইটাভাটাগুলোতে লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে নামমাত্র জরিমানা করে থাকেন। পাবনার তৈরী ইট জেলার গন্ডি পেরিয়ে উত্তর-দক্ষিনঞ্চলসহ দেশের নানা প্রান্তে সরবরাহ করা হচ্ছে।
পাবনার সিভিল সার্জন ডাঃ মনিসর চৌধুরীর কাছে এসব ইটভাটার ধোয়া ও ধুলাবালির কারনে পরিবেশ ও মানব শরীরের উপর কোন প্রভাব পড়বে কিনা জানতে চাইলে তিনি উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, অতিরিক্ত ধোয়ার কারনে বায়ু মন্ডলে কার্বনডাই অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যাবে। ইটভাটার আশে পাশে প্রাইমারী স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও মানুষ বসবাস করার ফলে তাদের ফুসফুসে সংক্রমন হতে পারে। সেই সাথে শ্বাসকষ্টসহ নানাবিধ অসুখ হতে পারে। পরিবেশের ভারসাম্যহীন হয়ে ঘটতে পারে ব্যাপক স্বাস্থ্য ঝুকি।
জেলার কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ ড. মোঃ সাইফুল আলম বলেন, কৃষি জমি খনন করে ইটভাটায় ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই। কৃষি জমি একমাত্র কৃষির জন্য ব্যাবহার করতে হবে। ইটভাটায় মাটি সরবরাহের ফলে আবাদী জমি হৃাস পাবে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ফসল উৎপাদন কমে যাবে।
পরিবেশ অধিদপ্তর, পাবনা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোঃ নাজমুল হোসাইন এর কাছে জানতে চাওয়া হয় এসব ইটভাটা কিভাবে অনুমোদন ছাড়াই চলছে। আপনারা কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমার দপ্তরে পর্যাপ্ত জনবল নেই। অভিযান চালাতে গেলে ম্যাজিষ্ট্রেট প্রয়োজন হয়। সেই সাথে আইনশৃংখলা রক্ষার জন্য প্রয়োজন হয় পুলিশের। আমরা অভিযান চালাতে গেলে দুই দপ্তরের সমন্বহীনতার কারনে সঠিকভাবে অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। এছাড়া ভাটা উচ্ছেদ করতে গেলে যে সকল যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়, সেগুলো আমাদের নেই। ফলে এসব ভাটার মালিকেরা বিনাবাধায় অবৈধভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে আমরা অভিযান পরিচালনা করে থাকি। তবে তিনি এও জানান, অবৈধ ইটাভাটা উচ্ছেদের বিষয়ে সম্প্রতি হাইকোটের রিটের একটি আদেশ এসেছে। এই আদেশের বলে আমরা খুব শিঘ্রই জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদের অভিযান শুরু করবো।
অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা এবং প্রতিটি ভাটা থেকে বছরে ২ লাখ টাকা উৎকোচ গ্রহনের অভিযোগের বিষয়ে জানতে পাবনা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে একাধিক গেলে পাবনার জেলা প্রশাসক বিশ্বাস রাসেল হোসেন সাংবাদিকের সাথে এ বিষয়ে কোন কথা বলতে রাজি হননি। এমনকি মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।
যত্রতত্রভাবে গড়ে ওঠা অনুমোদনহীন এসব ইট ভাটার কারনে ও জ¦ালানি হিসাবে কাঠ ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে অন্যদিকে ধুয়া ও ধুলাবালির কারনে ভাটা ও ভাটা সংলগ্ন আশে পাশে বসবাসকারীদের স্বাস্থ্য বিপর্যয় ঘটতে পারে। পাবনার সচেতন মহল মনে করেন, দ্রæত এসব অনুমোদনহীন ভাটাগুলোতে অভিযান চালিয়ে ধ্বংস করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও স্বাস্থ্যঝুকি এড়াতে উর্দ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।