অন্যথায়, যুদ্ধবিরতি দীর্ঘস্থায়ী শান্তি আনতে সক্ষম হবে না।
রাশিয়ার দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে—ইউক্রেনকে ন্যাটো সদস্যপদ না দেওয়া; ইউক্রেনে বিদেশি সেনা মোতায়েন না করার বিষয়ে সমঝোতা; অধিকৃত ক্রিমিয়া ও চারটি প্রদেশকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া।
এদিকে মস্কো যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সমর্থন না দিলে দেশটির ওপর ব্যাপক আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের পথে হাঁটতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) মস্কোতে এক সংবাদ সম্মেলনে পুতিন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব সম্পর্কে বলেন, ‘এই ধারণাটি (পরিকল্পনা) সঠিক এবং আমরা এটিকে সমর্থন করি। কিন্তু এমন কিছু প্রশ্ন রয়েছে, যেগুলো নিয়ে আলোচনা করা দরকার। ’
পুতিন আরও বলেন, ‘যুদ্ধবিরতিকে দীর্ঘস্থায়ী শান্তির দিকে নিয়ে যেতে হবে এবং এই সংকটের মূল কারণগুলো দূর করতে হবে।’
তবে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে মার্কিন অংশীদারদের সঙ্গে আরও আলোচনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে উল্লেখ করে পুতিন বলেন, ‘হয়তো আমি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনালাপ করব।’
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট আরও যোগ করেন, ‘৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি ইউক্রেনের জন্য ভালো হবে। আমরা এর পক্ষে, তবে কিছু সূক্ষ্ম বিষয় রয়েছে।’
যুদ্ধবিরতির অন্যতম বিতর্কিত বিষয় হলো রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চল। গত বছরের আগস্টে হঠাৎ হামলা চালিয়ে রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল ইউক্রেন। তবে দেশটির প্রেসিডেন্ট দাবি করছেন, রাশিয়া সম্পূর্ণভাবে কুরস্ক নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে এবং সেখানে ইউক্রেনীয় সেনারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
পুতিন বলেন, ‘তারা (ইউক্রেনীয় সেনা) পালানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু আমরা নিয়ন্ত্রণে আছি। তাদের সামরিক সরঞ্জাম পরিত্যক্ত হয়েছে।’
পুতিন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘কুরস্কে ইউক্রেনীয় সেনাদের জন্য দুটি বিকল্প আছে—আত্মসমর্পণ করা বা মারা যাওয়া।’
যুদ্ধবিরতির কার্যকারিতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট । তিনি বলেন, ‘এই ৩০ দিন কীভাবে অতিবাহিত হবে? ইউক্রেন কি এই সময়ে নতুন সেনা নিয়োগ করবে? পুনরায় অস্ত্র সংগ্রহ করবে? সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেবে? নাকি কিছুই করবে না?’
যুদ্ধবিরতির তদারকি কারা করবে, এমন প্রশ্ন তুলে পুতিন বলেন, ‘এটি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে? কে যুদ্ধ বন্ধের আদেশ দেবে? কোন শর্তে? প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ যুদ্ধক্ষেত্রে যদি কেউ যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে, তাহলে কে সিদ্ধান্ত নেবে? যুদ্ধবিরতির তদারকি করবে কে? এই সমস্ত প্রশ্ন উভয় পক্ষের কাছ থেকে পরিষ্কার আলোচনার দাবি রাখে।’
এদিকে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের রাশিয়ার সম্মত হওয়ার বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।
বৃহস্পতিবার রাতে জেলেনস্কি এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘পুতিন সরাসরি না বলেননি, কিন্তু বাস্তবে তিনি প্রত্যাখ্যানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘পুতিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সরাসরি বলতে ভয় পাচ্ছেন যে, তিনি এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চান এবং আরও ইউক্রেনীয়দের হত্যা করতে চান।’
রুশ নেতা এত বেশি শর্ত দিয়েছেন যে, কার্যত কোনো সমাধান সম্ভব নয়, এমনটিই দাবি জেলেনস্কির।
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে পুতিনের মন্তব্য ও জেলেনস্কির প্রতিক্রিয়ায় উভয় পক্ষের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন দেখা যাচ্ছে। ইউক্রেন চায়, দ্রুত যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা এবং দীর্ঘমেয়াদী সমঝোতার জন্য আলোচনা শুরু করা। অন্যদিকে রাশিয়া মনে করে, দীর্ঘমেয়াদী সমঝোতা নিশ্চিতের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা।
দুই পক্ষই তাদের নিজ নিজ অবস্থানে দৃঢ় থাকতে চাইছে। ইউক্রেনের কৌশল, রাশিয়ার ওপর চাপ বাড়ানো, যাতে পুতিনকে যুদ্ধবিরতির জন্য অনিচ্ছুক ‘ভিলেন’ হিসেবে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরা যায়। অন্যদিকে রাশিয়া মনে করে, ন্যাটো সম্প্রসারণ ও ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে তাদের উদ্বেগগুলো উত্থাপন করার এখনই মোক্ষম সুযোগ।
এদিকে চলমান পরিস্থিতিতে নতুন চ্যালেঞ্জে পড়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কারণ তিনি যুদ্ধবিরতি কার্যকরে দ্রুত একটি সমাধান চান। কিন্তু বল এখন পুতিনের কোটে, তিনি আরও খেলতে চান। ফলে বিষয়টি ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে (যুদ্ধবিরতি) আরও জটিল করে তুলতে পারে।
পুতিনের মন্তব্যে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া
যুদ্ধবিরতি প্রসঙ্গে পুতিনের এমন মন্তব্যের পরও আশাবাদী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউসে এক বক্তব্যে ট্রাম্প বলেন, তিনি রাশিয়ান নেতার সঙ্গে দেখা করতে ‘ভালোবাসবেন’। একই সঙ্গে তিনি আশা করেন, রাশিয়া ‘সঠিক কাজটি’ করবে এবং প্রস্তাবিত ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘আমরা রাশিয়ার কাছ থেকে একটি যুদ্ধবিরতি দেখতে চাই।’
এর আগে ওভাল অফিসে ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুটের সঙ্গে এক বৈঠকে ট্রাম্প জানান, ইতোমধ্যে তিনি ইউক্রেনের সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তির বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমরা ইউক্রেনের সঙ্গে জমি ও অঞ্চলগুলোর বিষয়ে আলোচনা করেছি—কোন এলাকা রক্ষা করা হবে ও কোনটি হারাতে হবে। এই সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তির অন্যান্য বিষয়গুলোও আলোচনা করা হয়েছে।’
এ সময় ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে ট্রাম্প বলেন, ‘এটার উত্তর সবারই জানা আছে।’
এমতাবস্থায় যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে আরও মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় পড়তে রাশিয়া। ইতোমধ্যে রাশিয়ার তেল ও গ্যাস খাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। রাশিয়ার তেল কেনা অন্যান্য দেশের জন্য ‘মার্কিন অর্থপ্রদান ব্যবস্থা’ ব্যবহার করা কঠিন করে তোলা হয়েছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আক্রমণ শুরু করে রাশিয়া। বর্তমানে দেশটি ইউক্রেনের প্রায় ২০ শতাংশ ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, যুদ্ধে ৯৫ হাজারের বেশি রুশ সৈন্য নিহত হয়েছে। অন্যদিকে গত বছরের ডিসেম্বরে ইউক্রেন দবি করে, যুদ্ধে ৪৩ হাজার ইউক্রেনীয় সেনা নিহত হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্লেষকরা মনে করেন ইউক্রেনের প্রকৃত নিহতের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।