এ নিয়ে অক্টোবর ২০২৩ থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি আগ্রাসনের পর অপুষ্টিজনিত মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০১-এ, যার মধ্যে ৮০ জনই শিশু। খবর আল জাজিরার।
জাতিসংঘ পরিস্থিতিকে আখ্যা দিয়েছে “একটি ভয়াবহ প্রদর্শনী” হিসেবে যেখানে মৃত্যু, ধ্বংস এবং মানবিক বিপর্যয়ের মাত্রা সাম্প্রতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন।
নিহত শিশুদের মধ্যে রয়েছে মাত্র ছয় সপ্তাহ বয়সী ইউসুফ আল-সাফাদি, যার মৃত্যু হয়েছে উত্তর গাজা সিটির একটি হাসপাতালে। আরেক শিশু, ১৩ বছর বয়সী আব্দুল হামিদ আল-ঘালবান, মারা যায় দক্ষিণের খান ইউনিসে। ইউসুফের চাচা আদহাম আল-সাফাদি বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে বলেন, শিশুটির মা দুধ উৎপাদন করতে পারছিলেন না কারণ তিনিও খেতে পারছিলেন না। বাজারে দুধ নেই, থাকলেও এক ক্যান দুধের দাম ১০০ ডলার।
তিনি বলেন, “দুধ পাওয়া যায় না। আর পেলেও এক কৌটা ১০০ ডলার। খাবার নেই, পানিও নেই তাই দুধ নেই। ইউসুফ অপুষ্টিতে মারা গেছে।”
ইসরায়েল মার্চ থেকে গাজায় খাদ্য, পানি, জ্বালানি এবং চিকিৎসা সামগ্রী প্রবেশে প্রায় সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। মে মাস থেকে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) সীমিত সহায়তা সরবরাহ শুরু করলেও, জাতিসংঘ বলছে জিএইচএফ এর বিতরণ কেন্দ্রের কাছে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে ইতিমধ্যে এক হাজার জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
মঙ্গলবার ৮১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন, যার মধ্যে ৩১ জন ছিলেন ত্রাণপ্রত্যাশী। এছাড়া একটি আশ্রয়কেন্দ্র লক্ষ্য করে হামলায় ১৫ জন এবং শাতি শরণার্থী ক্যাম্পে হামলায় আরও ১৩ জন নিহত হন।
এদিকে, জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস নিরাপত্তা পরিষদে বলেন, “প্রতি দরজায় এখন ক্ষুধার কড়া নাড়া। মানবিক সহায়তার নীতিনির্ভর কাঠামোটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।”
তিনি জানান, কেন্দ্রীয় দেইর আল-বালাহ শহরের বাসিন্দাদেরও পুনর্বাসনের আদেশ দিয়ে ইসরায়েল সেখানেও অভিযান জোরদার করেছে। ফলে গাজার প্রায় ৮৮ শতাংশ এলাকা এখন সামরিকীকরণ অথবা বাস্তুচ্যুতির আওতায় পড়েছে।
আল-শিফা হাসপাতালের পরিচালক ড. মোহাম্মদ আবু সালমিয়া বলেন, “ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে মৃত্যু ‘ভয়াবহ মাত্রায়’ পৌঁছাতে পারে।”
আল-আকসা হাসপাতালের মুখপাত্র খলিল আল-দাকরান জানান, “বন্দুকের গুলিতে আহতদের সামাল দিতেই হিমশিম খাচ্ছি। ক্ষুধারত রোগীদের জন্য আলাদা কোনো চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ নেই।”
তিনি বলেন, ৬ লাখ মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছেন, যার মধ্যে অন্তত ৬০ হাজার গর্ভবতী নারী। লক্ষণ হিসেবে পানিশূন্যতা ও রক্তাল্পতা দেখা যাচ্ছে।
ইউএনআরডব্লিউএ প্রধান ফিলিপ লাজারিনি বলেন, “ডাক্তার, নার্স, সাংবাদিক, এমনকি ত্রাণকর্মীরাও ক্ষুধায় অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন।”
তিনি আরও বলেন, “জিএইচএফ-কে ঘিরে সহায়তা পাওয়া এখন মৃত্যুঝুঁকির মতো যেখানে স্নাইপাররা যেকোনো সময় গুলি ছুড়ছে, যেন তাদের ‘মারার লাইসেন্স’ দেওয়া হয়েছে।”
নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল (এনআরসি)-এর মহাসচিব জান এজেল্যান্ড বলেন, “আমাদের শেষ তাঁবু, শেষ খাদ্যপ্যাকেট, সবই বিতরণ করা হয়ে গেছে। কিছুই আর নেই।”
তিনি বলেন, “শত শত ট্রাক ত্রাণ সামগ্রী মিশরের রাফাহ সীমান্তে আটকে আছে। কিন্তু সেগুলো ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ইসরায়েল আমাদের কাজ পঙ্গু করে দিতে চায়।”
ইসরায়েল অবশ্য বেসামরিক মানুষকে লক্ষ্যবস্তু বানানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং খাদ্য সংকটের দায় নাকচ করেছে। জিএইচএফ জাতিসংঘের পরিসংখ্যানকে ‘ভুল এবং অতিরঞ্জিত’ বলেও দাবি করেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব টেড্রোস অ্যাধানম গেব্রেইয়েসুস জানান, ইসরায়েলি সেনারা দেইর আল-বালাহ এলাকায় ডব্লিউএইচও কর্মীদের আবাসনে তিনবার হামলা চালায়, নারীদের সরিয়ে দেয়, পুরুষদের হাতকড়া পরিয়ে বিবস্ত্র করে। চারজন কর্মীকে আটক করা হয়, যাদের একজন এখনো আটক রয়েছেন।
ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ৫৯ হাজার ১০৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যার বেশিরভাগই নারী ও শিশু। আহত হয়েছেন ১ লাখ ৪২ হাজার ৫১১ জন।
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় কাতারে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে পরোক্ষ আলোচনা চললেও, ইসরায়েলি সেনাদের পুনঃমোতায়েন ইস্যুতে অচলাবস্থা রয়ে গেছে।