আন্তর্জাতিক ডেস্ক, সিএনএন বিডি ২৪.কম: লেবাননের দক্ষিণ বৈরুতের দাহিয়াহ এলাকায় ইহুদিবাদী ইসরায়েলের সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি একটি অবিস্ফোরিত জিবিইউ-৫৭ (GBU-39B) ক্ষেপণাস্ত্র পাওয়া গেছে। এই ঘটনাটিকে ঘিরে প্রতিদিন নতুন নতুন তথ্য গণমাধ্যমে আসছে।
যুক্তরাষ্ট্র এই ক্ষেপণাস্ত্র ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মরিয়া চেষ্টা করায় কিছু গণমাধ্যম দাবি করছে যে, অত্যাধুনিক এই অস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত তথ্য ইতোমধ্যে ইরানের হাতে পৌঁছে গেছে!
গত ২৪ নভেম্বর ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ৮টি নির্ভুল ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে বৈরুতের দাহিয়াহ এলাকায় হামলা চালায়। এর মধ্যে ৭টি বিস্ফোরিত হয়, কিন্তু অষ্টম ক্ষেপণাস্ত্রটি (জিবিইউ-৩৯বি) পুরোপুরি অক্ষত অবস্থায় মাটিতে পড়ে। ছবিতে দেখা যায়, ক্ষেপণাস্ত্রের ডানা ও বডি সম্পূর্ণ অক্ষত। এটি ফিউজ বা বিস্ফোরক প্রক্রিয়ায় ত্রুটির কারণে ঘটেছে সামরিক ওয়েবসাইট ‘এশিয়ান ডিফেন্স সিকিউরিটি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে, “এই বিরল ঘটনাটি ফিউজ বা বিস্ফোরণ প্রক্রিয়ায় একটি ত্রুটির ইঙ্গিত দেয়, যা মার্কিন প্রযুক্তি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের জন্য বাজে দৃশ্যকল্প তৈরি করে।
‘এশিয়ান ডিফেন্স সিকিউরিটি’ আরও দাবি করেছে, “লেবাননের হিজবুল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলে এত উন্নত মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র অক্ষত অবস্থায় পড়ে থাকার বিষয়টি ওয়াশিংটনের জন্য একটি বড় ধরনের সংকটে পরিণত করে। ” এ কারণে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মার্কিন কূটনীতিকরা লেবাননের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যোগাযোগ করে ক্ষেপণাস্ত্রটি ফেরত চান।
আরব গণমাধ্যম আল-মাশহাদ ও নাশরা, লেবাননের সরকারি সূত্রের বরাতে মার্কিন অনুরোধের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, ওয়াশিংটন বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন যে, এই অস্ত্রের গোপন প্রযুক্তি ইরান, চীন বা রাশিয়ার কাছে পৌঁছে গেলে তা যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সক্ষমতার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
জিবিইউ-৩৯বি হলো মার্কিন ও ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর ব্যবহৃত ২৫০ পাউন্ড ওজনের নির্ভুল গাইডেড বোমা। ছোট আকার ও উন্নত জিপিএস-নির্ভর গাইডেন্সের কারণে এটি আধুনিক বিমান হামলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র। ডানা খুলে এটি প্রায় ৭৪ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারে এবং রাডার এড়ানোর সক্ষমতাও রয়েছে।
‘এশিয়ান ডিফেন্স সিকিউরিটি’ জিবিইউ-৩৯বি-এর বৈশিষ্ট্যগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে বলেছে, এই ক্ষেপণাস্ত্রটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রাগারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্ভুল ও কৌশলগত অস্ত্রের মধ্যে একটি। এটি আকারে বড় ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর চেয়ে দামে সস্তা হলেও, এর পেছনে বিনিয়োগ করা প্রযুক্তির মূল্য অনেক বেশি। কোটি কোটি ডলার খরচ করে এমন প্রযুক্তি তৈরি করা হয়েছে, যার ফলে ক্ষেপণাস্ত্রটি একসাথে অনেকগুলো বিশেষ গুণ পেয়েছে: এটি অনেক দূর থেকে আঘাত করতে পারে, লক্ষ্যভেদে অত্যন্ত সঠিক, শত্রুর রাডার থেকে আড়াল হওয়ার ক্ষমতা রাখে এবং যেকোনো আবহাওয়ায় কাজ করতে পারে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে: “২৫০ পাউন্ড (১১৩ কেজি) ওজনের এবং কমপ্যাক্ট মাত্রার এই ক্ষেপণাস্ত্র এফ-১৫ই, এফ-৩৫ এবং এফ-১৬ যুদ্ধবিমানগুলোকে একক সর্টিতে একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম করে। ক্ষেপণাস্ত্রটির ডানা ছেড়ে দেওয়ার পরপরই প্রসারিত হয়, যা এটিকে ৭৪ কিলোমিটার (৪০ নটিক্যাল মাইল) উড়তে দেয়। এটি আধুনিক যুদ্ধের একটি অত্যাবশ্যক বৈশিষ্ট্য যেখানে যুদ্ধবিমানগুলোকে উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ বিমান প্রতিরক্ষা এলাকায় প্রবেশ না করেই লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে হবে।
‘এশিয়ান ডিফেন্স সিকিউরিটি’ সামরিক ওয়েবসাইটটি স্পষ্ট করে বলেছে: “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এই ক্ষেপণাস্ত্র কেনার পর থেকে ইসরাইল এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে। প্রায় ২০১০ সাল থেকে ইসরায়েল প্রতিটি বড় বিমান হামলায় বিশেষকরে ২০২৪-এ গাজা এবং দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহ কমান্ড সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে অপারেশনেও এই মডেলের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।
‘এশিয়ান ডিফেন্স সিকিউরিটি’ মনে করে—“এই ক্ষেপণাস্ত্রের তথ্য ইরানের কাছে ফাঁস হলে এটি দেশের নির্ভুল ক্ষেপণাস্ত্র এবং ক্রমবর্ধমান ড্রোন অস্ত্রাগারের কর্মসূচিকে ত্বরান্বিত করতে পারে। পাশাপাশি জিবিইউ-৩৯বি হারানো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য, কেবল একটি সামরিক বিব্রতকর ঘটনা নয়, বরং একটি কৌশলগত দুর্বলতাও।”
ইয়েমেনের গণমাধ্যম আল-মাসিরাহ সম্প্রতি দাবি করেছে, হিজবুল্লাহ বোমাটির ছবি ও গুরুত্বপূর্ণ ইলেকট্রনিক উপাদান ইরানের কাছে পাঠিয়েছে। তাদের তথ্যমতে, একটি বিশেষ ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে বোমাটিকে নিরাপদ করে এবং বিশ্লেষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অংশ আলাদা করে।
আল-মাসিরাহ আরও দাবি করে—“গত ২২ জুন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ট্রাম্পের নির্দেশে হামলার সময় ১৩ টন ওজনের একটি ভারী জিবিইউ-৫৭ বোমা (যা ‘মাদার অফ অল বোম্বস’ নামে পরিচিত) ব্যবহার করা হয়েছিল। তবে, একটি বোমা বিস্ফোরিত না হওয়ায় তা ইরানি বিশেষজ্ঞদের হাতে চলে গেছে। একটি ইরানি সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, তেহরান এই ১৩-টন ওজনের বোমাটির রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং করতে সক্ষম হয়েছে।
আল মাসিরাহর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরান জিবিইউ-৫৭-এর মতো ভারী বোমার নকশা আয়ত্ত করলেও, এর ব্যবহার সীমিত করেছে। ইরান তার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ওয়ারহেডে ভারী বোমার পরিবর্তে মার্কিন প্রযুক্তির জিবিইউ-৫৭ শ্রেণির হাল্কা বোমা স্থাপন করতে চায়।
আল-মাসিরাহর দাবি, ইরানি বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যে জিবিইউ-৫৭ মডেলের একটি বিশেষ ওয়ারহেড তৈরি করেছেন, যা হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ফাত্তাহ (১৪০০ কিমি) এবং খোররামশহর-৪ (২০০০ কিমি)-তে ব্যবহারের উপযোগী। পরীক্ষায় দেখা গেছে, ইরানি ওয়ারহেড ২০ মিটার পর্যন্ত রিইনফোর্সড কংক্রিট ভেদ করতে পারে, যদিও মার্কিন মূল সংস্করণ ৬০ মিটার পর্যন্ত প্রবেশ করতে সক্ষম।
আঞ্চলিক বিশ্লেষকদের মতে, একটি অক্ষত জিবিইউ-৩৯বি কিংবা জিবিইউ-৫৭ ইরানের হাতে গেলে তা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি সামরিক পরিকল্পনাকে দীর্ঘমেয়াদে চ্যালেঞ্জ করবে। এটা কেবল তাদের সামরিক লজ্জা নয়, বরং প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব হারানোর ঝুঁকিও তৈরি করেছে।
এর আগে ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক আরকিউ-১৭০ সেন্টিনেল স্টিলথ ড্রোন সফলভাবে আকাশ থেকে নামিয়ে আনে। ড্রোনটি আফগানিস্তানের কান্দাহারে অবস্থিত মার্কিন বিমান ঘাঁটি থেকে উড়ে এসে ইরানের আকাশসীমায় প্রবেশ করেছিল। ইরানের সাইবার প্রতিরক্ষা ইউনিট ড্রোনটির জিপিএস সিস্টেম হ্যাক করে সেটিকে নিরাপদে নামিয়ে আনতে সক্ষম হন। উন্নত মার্কিন ড্রোনটির অবকাঠামো, নকশা ও প্রযুক্তিতে সরাসরি প্রবেশাধিকার পেয়ে ২০২০ সালে দেশটি তৈরি করে শাহেদ-১৬১ ড্রোন, যা আজ ইরানের ড্রোন প্রযুক্তি স্বনির্ভরতার প্রতীক।