ধর্ষকের বিরুদ্ধে বিচারহীনতার যে দীর্ঘ ইতিহাস, সেই প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের এমন আবেগতাড়িত বক্তব্য স্বাভাবিক। তবে যখন রাষ্ট্রের আইনপ্রণেতা এবং সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকেরা ধর্ষণ বন্ধের একমাত্র ফর্মুলা হিসেবে কখনো কখনো মৃত্যুদণ্ড, এমনকি বিচারবহির্ভূত হত্যাকেও ব্যক্তিগতভাবে সমর্থন করেন, তখন তা প্রকারান্তরে আইনের শাসনের উপস্থিতিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
ধর্ষককে মৃত্যুদণ্ডই দিতে হবে—সাধারণ মানুষের এই দাবির ভাষাতেও বোধ করি পরিবর্তন প্রয়োজন। শুধু মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেই যদি ধর্ষণ বন্ধ করা যেত, তবে কিন্তু গত ২০ বছরে যে ক্রমাগত ধর্ষণের পর হত্যা বা সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, সেটি হওয়ার কথা ছিল না। ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করি। যে ধর্ষণ করে বা করতে চায়, তার বেঁচে থাকার নৈতিক অধিকার আছে বলে মনে করি না। তবে মৃত্যুদণ্ডের আইন করে দিলেই ধর্ষণ কমে যাবে এমনটা আমি মনে করি না।
যদি সাজার ভয়েই ধর্ষণ কমতো তাহলে তো যাবজ্জীবন এমনকি ৫ বছরের জেলে থাকার ভয়েই মানুষ ধর্ষণ করতো না। কাজেই আইন করে অপরাধ কমবে সেটা আমার মনে হয় না। এখানে দরকার আসলে আইনের শাসন। দরকার সুশাসন। দিনের পর দিন আইনের শাসনের মধ্য্ দিয়ে এমন একটা সংস্কৃতি আমাদের গড়তে হবে যেখানে প্রত্যেকটা মানুষের মনে এই ভয় ঢুকবে যে আইন ভাঙলে তার সাজা হবে। কাজেই রাষ্ট্রের কাছে আমি যত না আইন চাই, তার চেয়ে বেশি চাই আইনের শাসন।
আরেকটা বিষয় ও দ্রুততম সময়ে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। ধর্ষণের মতো অপরাধের একেকটা ঘটনার বিচারে এক থেকে তিন মাস সময় নেওয়া উচিত। এর বেশি কোনভাবেই না।
আর শুধু আইন তৈরি করলেই হবে না আইনের বাস্তবায়নও করতে হবে। বাংলাদেশে যতো ভালো ভালো আইন বা নীতি আছে পৃথিবীর খুব কম দেশেই ততো আছে। আইন তৈরির দিক থেকে আমরা সেরা। কিন্তু আইনের প্রয়োগ বা বাস্তবায়নের দিক থেকে আমরা ভয়াবহভাবে পিছিয়ে।
ভেবে দেখেন অর্থ পাচার করলে কঠিন শাস্তির আইন আছে কিন্তু তারপরেও বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয় কারণ পাচারকারীরা জানে তাদের কিছু হবে না। এই দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইন আছে, আছে দুর্নীতি দমন কমিশন, কিন্তু দুর্নীতিবাজরা এসবের তোয়াক্কা করে না। তারা জানে হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করলেও তাদের কিছু হবে না।
এই যে যারা অপরাধ করে, যারা কোন না কোনভাবে ক্ষমতাশীল তারা সবাই জানে এই দেশে যা ইচ্ছে তাই করা যায়। মূলত এ কারণেই এখানে অপরাধ কমে না। সমস্যার সমাধান তাহলে কী? সমাধান একটাই রাষ্ট্রকে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করতে হবে যেখানে আইন সবার জন্য সমান। যেখানে অপরাধীরা ভাবতে বাধ্য হবে তার যতোই ক্ষমতা থাকুক, যতোই টাকা থাকুক অপরাধ করলে পার পাবে না। কাজেই রাষ্ট্রকে এখানে আইনের সুশাসন তৈরি করতে হবে।
রাষ্ট্রের পাশাপাশি ব্যক্তির একটা কর্তব্য আছে। আর সেটার নাম বোধ। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে এই বোধ থাকতে হবে যে মানুষ হিসেবে আমি কোন অন্যায় করবো না। কোন অন্যায় প্রশয় দেব না। সবময় মানুষের পাশে দাড়াবো। এই মূল্যবোধ যদি না গড়ে ওঠে তাহলেও সমস্যার সমাধান হবে না।
তবে একটা কথা হলো আইনের শাসন আর ব্যক্তির মূল্যবোধ পরষ্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। একটা রাষ্ট্রে যদি দিনের পর দিন সুশাসন থাকে তাহলে নাগরিকদের মধ্যে আইন মানার প্রবণতা আসে। বোধ তৈরি হয়। আবার বোধ তৈরি হলে রাষ্ট্রও ঠিকমতো চলে।
সমস্যা হলো বাংলাদেশে আমরা ব্যক্তিও ঠিক হই না, রাষ্টও না।
কাজেই আশার আলোগুলো এখানে ফিকে হয়ে যায়। তবুও জোর করে আশায় বুক বাঁধি একদিন হয়তো এই দেশটা ঠিক হবেই। শুধু জানি না কবে! শুধু জানি না জীবনদশায় একটা সুন্দর বাংলাদেশ দেখে যেতে পারবো কী না যেখানে আইনের শাসন আছে, বোধ আছে।
লেখক: আফছানা রহমান, বার্তা সম্পাদক সিএনএন বিডি.টিভি।