মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দর উন্নয়ন: সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশের যাত্রা!
বুধবার, ১১ নভেম্বর, ২০২০
মো. জাহাঙ্গীর আলম খান: সমুদ্রপথে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানির হার বৃদ্ধির সাথে সাথে বন্দরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণও দ্রুত বাড়ছে। চট্টগ্রাম বন্দর ধারণক্ষমতার বাইরে গিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম করছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের উপর অতিরিক্ত চাপ কমানো এবং ব্যাপক সংখ্যক জাহাজ এবং কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ‘মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ভবিষ্যত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চাহিদাকে সামনে রেখে বাংলাদেশের কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৬ মিটার গভীরতা এবং ৮,০০০ টিইইউ’স (বিশ ফুট দৈর্ঘের কন্টেইনার) ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন কন্টেইনার জাহাজ প্রবেশ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য কক্সবাজার জেলার মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে। এ বন্দরের পোতাশ্রয়ে ১৬ মিটার পর্যন্ত ড্রাফটের জাহাজ প্রবেশ করতে পারবে। ফলে সামগ্রিক পরিবহণ ব্যয় হ্রাস পাবে আনুমানিক ১৫ শতাংশ। মাতারবাড়ি বন্দর সড়ক, রেল ও নদীপথ দিয়ে সংযুক্ত থাকবে। বন্দরকে কেন্দ্র করে একটি সুপরিকল্পিত কানেক্টিভিটি গড়ে উঠবে। যার ফলে যে-কোনো পণ্য সহজে এবং কম খরচেই পৌঁছে যাবে আমদানি-রপ্তানিকারকেদের দোরগোড়ায়। এ বন্দর দিয়ে কয়লা, লিক্যুয়িড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি), অপরিশোধিত তেল ও তেল পণ্য, সিমেন্ট, ক্লিঙ্কার, সার, খাদ্যশস্য, স্টিলপণ্য এবং স্ক্র্যাপ লোহা আমদানি সহজতর হবে।
জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলায় মাতারবাড়ি ও ধলঘাট এলাকায় বন্দরটি নির্মিত হবে। নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ‘মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করবে। মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭,৭৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২,৮৯২ কোটি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (নিজস্ব তহবিল) ২,২১৩ কোটি এবং বাংলাদেশ সরকারের ২,৬৭১ কোটি টাকা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কজ শেষ হবে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ মাতারবাড়ি বন্দরের অংশ এবং সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ মাতারবাড়িবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের সড়ক অংশ বাস্তবায়ন করবে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়নের লক্ষ্যে ৪৬০ মিটার দৈর্ঘের কন্টেইনার জেটি, ৩০০মিটার দৈর্ঘ্যরে মাল্টিপারপাস জেটি এবং ১৪.৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে চ্যানেল নির্মাণ করবে। চ্যানেলের গভীরতা হবে ১৬ মিটার ও প্রস্থ হবে ৩৫০ মিটার। এছাড়া ৩৯৭ মিটার নর্থ ব্রেক ওয়াটার বাঁধ বর্ধিতকরণ, দু’টি কী-গ্যান্ট্রি ক্রেণ, একটি মাল্টি-পারপাস গ্যান্ট্রি ক্রেণ, ছয়টি রাবার টায়ার্ড গ্যান্ট্রি ক্রেণ ও তিনটি টাগবোট ক্রয় করবে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থায়নে পুণর্বাসনসহ জমি অধিগ্রহণ, আয়কর, শুল্ক এবং ভ্যাটবাবদ ব্যয়, প্রকল্পের যানবাহন, জনবল এবং বাস্তবায়ন ব্যয়সমূহ সম্পন্ন হবে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ চারলেন বিশিষ্ট ২৭ দশমিক ৭ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক, ১৭টি ছোটো-বড়ো ব্রিজ (ব্রিজগুলোর মোট দৈর্ঘ্য ৭,০৯৪ মিটার), এক দশমিক ছয় কিলোমিটার ডাইক রোড এবং সার্ভিস রোড নির্মাণ করবে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ি প্রতিবছর বাংলাদেশে জাহাজ আগমন বৃদ্ধির হার ১১ শতাংশের বেশি। বর্তমান কন্টেইনার হ্যান্ডলিং প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে দেশে বার্ষিক কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৪০ লাখ (১৪ মিলিয়ন) টিইইউ’স এবং জাহাজের সংখ্যা দাঁড়াবে ৮,২০০টি। এ বিপুলসংখ্যক কন্টেইনার ও জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা দেশের বর্তমান সমুদ্র বন্দরগুলোর নেই। দেশে বর্তমানে যে কয়টি সমুদ্র বন্দর রয়েছে তার কোনোটিই গভীর সমুদ্র বন্দর নয়। ফলে অধিক গভীরতার (ডীপ ড্রাফটের) জাহাজ এসব বন্দরের জেটিতে ভিড়তে পারে না। তাই, অধিক গভীরতার জাহাজের জেটি সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ নির্মাণ বিষয়ে অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং সরকারের ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রকল্পটি ২০২০ সালের ১০ মার্চ একনেক সভায় অনুমোদিত হয় এবং ০৭ মে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় হতে প্রশাসনিক অনুমোদন লাভ করে।
বাংলাদেশের উন্নয়নে জাপানের অংশীদারিত্ব চার দশকেরও বেশি সময়ের। বাংলাদেশকে কেন্দ্রে রেখে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে অর্থনৈতিক পরিকাঠামো নির্মাণে জাপানের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ ‘বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট অর্থাৎ বিগ-বি’। এটি বাংলাদেশে অবকাঠামোগত উন্নয়নে জাপানের সবচেয়ে বড়ো উদ্যোগ। বাংলাদেশ এবং জাপান সরকারের মধ্যে ২০১৪ সালে বিগ-বি এর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। বিগ-বি এর প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে মাতারবাড়িকে। এখানে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং অন্যান্য অবকাঠামোসহ নির্মাণ করা হচ্ছে বাণিজ্যিক বন্দর।
এখানে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক বিনিয়োগ হবে, সারা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন গতি ফিরে আসবে। ভূ-অবস্থানগত সুবিধা এবং গভীর সমুদ্র বন্দরের সক্ষমতা থাকায় বন্দরটি দক্ষিণ এশিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হবে। এ বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। বন্দরকে কেন্দ্র করে নিকটবর্তী এলাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে, উন্নয়ন দেখা দেবে অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থায়। ফলে কর্মস্থান বিপুলভাবে বাড়বে। আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধি পেলে রাজস্ব আয় বাড়বে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। দেশের ব্লু ইকোনমি তথা তেল-গ্যাস ও অন্যান্য
সমুদ্রসম্পদ আহরণ ও ব্যবহারের সুযোগ সম্প্রসারিত হবে। মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দরের উন্নয়নের পাশাপাশি আধুনিক কন্টেইনারবাহী জাহাজ, খোলাপণ্যবাহী জাহাজ ও তেলবাহী ট্যাঙ্কারকে জেটিতে ভেড়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। নিঃসন্দেহে বলা যায় এটি দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পথে মাইলফলক হবে নতুন এই সমুদ্র বন্দর।
বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে মাতারবাড়ির অবস্থান। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারাকে বেগবান করতে মহেশখালী-মাতারবাড়িকে কেন্দ্র করে ৩৪টি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। তার অংশ হিসেবে বদলে যাচ্ছে চিরচেনা মাতারবাড়ি। এখানে গড়ে উঠছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, কোল (কয়লা) জেটি, লিক্যুয়িড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনালসহ বাণিজ্যিক বন্দর। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অধীনে মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের তো বটেই, ভবিষ্যতে এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক হাব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে মাতারবাড়ি।
পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ১,২২৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এ লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই সম্ভাব্যতা যাচাই, ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং, এপ্রেইজল মিশন এবং ঋণচুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। জমি অধিগ্রহণের পাশাপাশি কনসালট্যান্ট, অন্তবর্তীকালীন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের কার্যক্রম পরিচালনার সুবিধার্থে চট্টগ্রাম বন্দরের সীমানা বাড়ানো হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের পোর্ট লিমিট বা বন্দরের সীমানা সাত গুণেরও বেশি বাড়িয়ে উত্তরে ফেনী নদীর মোহনা এবং দক্ষিণে কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও মাতারবাড়ি এলাকা পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
জাইকার সমীক্ষা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মহেশখালীর মাতারবাড়ি ও জাপানের কাশিমার ভূ-প্রকৃতি প্রায় একই ধরণের। তাই ‘কাশিমা’ বন্দরের মডেলেই মাতারবাড়ী বন্দর তৈরি করা হবে। সমুদ্রের সাথে নয়, চ্যানেল তৈরির মাধ্যমে বন্দরকে সমুদ্রের সাথে যুক্ত করা হবে। অর্থাৎ এটি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম খননকৃত বন্দর। এছাড়া চ্যানেলে যাতে পলি জমতে না পারে, সে লক্ষ্যে ব্রেকওয়াটার বাঁধ নির্মাণ করে পানির প্রবাহ রোধ করা হবে। কাশিমার আদলে তৈরি করা হলেও মাতারবাড়ি বন্দর হবে কাশিমা সমুদ্র বন্দরের থেকেও আড়াই গুণ বড়ো।
বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা ঝেড়ে ফেলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের অর্থনীতি। বিশ্ব গণমাধ্যমে একসময় শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নাম আসত এ দেশের। এখন উন্নয়নের নতুন মডেল হিসেবে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশকে। মাতারবাড়ি বাণিজ্যিক বন্দর পুরো দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প। এ বন্দর বাস্তবায়ন করা গেলে বিশ্বব্যাংক প্রকল্পিত শীর্ষ বৃহৎ অর্থনীতির পাঁচ দেশে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি অনেকখানিই তরান্বিত হবে। তাই মাতারবাড়ির রূপান্তরকে দেখা যায় সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশের যাত্রা হিসেবে।