তার মনে হচ্ছে ৩৮ বছর বয়সে জীবনটা অর্থহীন হয়ে গেল। ৭/৮ মাস ধরে লিলির পিরিয়ডের সময় প্রচন্ড পেটে পেইন সাথে প্রচুর ব্লিডিং হয় । রক্তশূন্যতার কারণে এর মাঝে শরীরের ব্লাড দিতে হয়েছে। পিরিয়ডের সময়ের গড়মিল দেখে গাইনি ডাক্তারের শরাপন্ন হলে লিলি জানতে পারে তার জরায়ুতে টিউমার। আর সার্জারি ছাড়া গত্যন্তর নাই। ৮ বছরের সংসার জীবনে এক ছেলে আর স্বামী নিয়ে ভালোই ছিল সব। কিন্তু দাম্পত্য জীবনে ঝড় নেমে এলো মেলো লিলি। জরায়ু না থাকলে একটা নারী নারীত্ব বলে কিছু থাকে না এটা সে শুনে আসছে আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধবের কাছে। তাই সে ভাবছে কথাটা গোপন রেখে জীবন পার করবে। কিন্তু ডাক্তার বলেছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টিউমার রিমুভ করতে হবে। আর আজকাল এ হিসরেক্টমি সার্জারিতে ভয়ের কিছু নেই।
কিন্তু সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষমতা হারানোর পাশাপাশি সহবাসে সমস্যা হয় এ ধারণা থেকে লিলির মত অনেক মেয়েই জরায়ুর সমস্যাকে আড়াল করে ক্যান্সারের শিকার হয় প্রতিনিয়ত। সাম্প্রতিককালের এক গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে ছয় হাজার নারী মারা যায় জরায়ুর ক্যান্সারের কারণে। সামাজিক পারিবারিক কুসংস্কার আর অজ্ঞতা এর জন্য বিশেষভাবে দায়ী।
লিলির মত শিক্ষিত মেয়ে নিজের জীবনকে যেখানে শুধুমাত্র জরায়ু থাকা না থাকা দিয়ে বিচার করে; সেখানে স্বল্প শিক্ষিত বা অক্ষরজ্ঞানহীন নারীদের পক্ষে খুব সহজ নয় এ ট্যাবু ভাংগা। জরায়ু শরীরের অন্য অর্গানামের মত একটি অর্গানাম। সমস্যার কারণে জরায়ু কেটে ফেলে দিলে সন্তান ধারন সম্ভব হয় না সত্যি। কিন্তু এতে করে নারী যৌন ক্ষমতা হারায় তা সম্পূর্ণ ভুল।
তবুও নারীরা জরায়ু বাদ দেয়ার বিষয়টি আড়াল করে। হীনমন্যতায় ভোগে মানসিক সংকট সৃষ্টি করে। জরায়ু বাদ দিলে জীবন অর্থহীন হয়ে যায় না -এটা সাহস করে বলতে হবে জরায়ু বাদ দেয়া নারীকে নিজের জীবন যাত্রা দিয়ে। কারণ নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে অন্যকে সচেতন করতে পারলে বিনা চিকিৎসায় বা ক্যান্সারের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাবে অন্য একজন নারী।
জরায়ু বাদ দেয়া নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার সে সাহস দেখিয়েছিল সামাজিক মাধ্যমে প্রখ্যাত সেতার বাদক রবি শংকরের কন্যা আনুস্কা। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সারা বিশ্বের নারীদের যে সাহস ও মনোবল দিয়েছিল তা সত্যি অসাধারণ।আনুস্কা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করেছিলেন নারীদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা গোপন কোন বিষয় নয়। এটা সবাইকে জানতে হবে বুঝতে হবে।
তিনি সোশ্যাল মিডিয়াতে তাই লিখেছিলেন , শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণে তিনিও এর আগে অবধি শরীরের নানাবিধ সমস্যা নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে লজ্জা পেয়েছেন। টিনেজার বয়স থেকে অসহ্য যন্ত্রণাময়, ১০-দিন স্থায়ী পিরিয়ডের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রেও আগে দ্বিধা ছিল তার। এখন তিনি অনেকটা পরিণত এবং মনে করেন যে নারীর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়গুলি নিয়ে কথা বলা জরুরি।
নিজের চিকিৎসা করাতে গিয়ে তিনি অবাক হয়েছিলেন অন্যদের হিসরেক্টমি সার্জারিকে গোপন করার বিষয় দেখে। আনুস্কা এ গোপনীয়তাকে নারীর নিজের দুর্বলতা বলে মনে করেছিলেন। সে সাথে তখন সিদ্ধান্ত নেন এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে কথা বলার।তিনি বলেন, হিসরেক্টমি যদি সাধারণতম সার্জারিগুলির একটি হয়, তবে সেটা নিয়ে আরো বেশি কথা হয়না কেন! আমার অবাক লাগতো দেখে যে, এই অপারেশনের বিষয়ে কেউ বিশেষ কথা বলে না। আমি অন্য একজন মহিলাকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, আমরা আমাদের গোপনাঙ্গের কথা সকলকে নিশ্চয়ই জানাতে যাব না!
আনুস্কা তার সার্জারী আর চিকিৎসা নিয়ে নিজের যে মানসিক সংকটের কথা বলেছিল, সেটা আর আট দশ জন নারী মত অনুভুতি।
কয়েক মাস আগে যখন জানতে পারলাম যে আমার জরায়ু বাদ দিতে হবে, তখন আমি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমার ভেতরে অনেকগুলো ভয় কাজ করছিল, নিজের নারীত্ব হারানোর ভয়, পরে ইচ্ছে থাকলেও সন্তান ধারণ না করতে পারার ভয়, সার্জারি টেবিলে মারা গেলে আমার ছোট্ট ছেলে দুটোকে রেখে চলে যাবার ভয়, আমার ব্যক্তিগত জীবনে এর প্রভাবের ভয়। আমি পরিবার-পরিজন এবং বান্ধবীদের এই বিষয়ে জানাই এবং জানতে পারি যে অনেকের হিসরেক্টমি হয়েছে, অথচ তারা আগে কখনো জানতেই পারিনি।
কিন্তু আনুস্কা সাহসী বলে সব প্রতিকুলতার সাথে লড়াই করে হিসরেক্টমি বা জরায়ু বাদ দেওয়ার কথাটি প্রকাশ্যে বলতে পেরেছিলেন। আর নিজের শরীরের ভেতরের ১৩টি টিউমার বয়ে বেড়ানো জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন।
আনুস্কার এ সাহস আর দৃঢ় মনোভাব থেকে প্রত্যেক মানুষের শেখা উচিত শরীরে কোন অসুখ হলে তার চিকিৎসা সবার আগে। সেটা শরীরের যেখানেই হোক বা জীবনের যত প্রয়োজনীয় অংগ হোক। সেখানে ভয়, লজ্জা বা জীবনকে অর্থহীন ভাবা বোকামি। আর তাই একজন নারীর জরায়ু বাদ দিলে তা নিয়ে লজ্জিত হবার কিছু নেই। কারণ একজন নারী মানে একটা জরায়ু নয়।
লেখক: আফছানা রহমান, বার্তা সম্পাদক সিএনএন বিডি ২৪.কম।