চীন সফরে সেভেন সিস্টার্স নিয়ে ড. ইউনূসের বক্তব্যে ভারতে তোলপাড়
বৃহস্পতিবার, ০৮ মে, ২০২৫
ফাইল ছবি
তোফায়েল আহম্মেদ, নিজস্ব প্রতিনিধি : ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্য ল্যান্ডলকড বা স্থলবেষ্টিত অঞ্চল— তা সবারই জানা। সমুদ্রপথে তাদের সরাসরি যোগাযোগেরও কোনো সুযোগ নেই।
ধ্রুব এই সত্যটিই শুধু বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস। এতেই যেন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছেন ভারতের গুটিকয়েক নেতা। যদিও একদিন আগেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঈদ শুভেচ্ছাবার্তায় দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করার ঘোষণা দেন। তবে ভৌগোলিক এই সত্যকেই যেন মেনে নিতে পারছেন না ভারতের কতিপয় নেতা, ইতোমধ্যে ছড়াতে শুরু করেছেন বিষবাষ্প।
সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের পাঠানো বিশেষ ফ্লাইটে চড়ে দেশটিতে পৌঁছান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনূস। চার দিনের সেই সফরে সেভেন সিস্টার্স নিয়ে তাঁর করা মন্তব্যে ভারতীয় নেতাদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। যেখানে দেশের অবস্থানকে তুলে ধরা হয়েছে এই অঞ্চলে সমুদ্রপথে যোগাযোগের অভিভাবক হিসেবে। এতে দুশ্চিন্তার পাশাপাশি ভারতীয় নেতাদের অনেকে ক্ষেপেছেনও। দুষছেন নিজের দেশের পররাষ্ট্রনীতিকেই। বলেছেন, এমন বক্তব্যকে ‘হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়’। যদিও সফর শেষে দেশে ফেরার একদিন পরই ঈদুল ফিতর উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ও বাংলাদেশের জনগণকে শুভেচ্ছা জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যেখানে দুদেশের মধ্যে অংশীদারত্বকে এগিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন তিনি।
সেভেন সিস্টার্স নিয়ে ভাইরাল ভিডিও ক্লিপে ড. ইউনূস বলেন, ‘ভারতের সাতটি রাজ্য, দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় অংশ যেটিকে বলা হয় সেভেন সিস্টার্স। এটি ভারতের স্থলবেষ্টিত অঞ্চল। তাদের সমুদ্রে পোঁছানোর কোনো সুযোগ নেই। এই অঞ্চলের জন্য আমরা সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক। এটি ব্যাপক সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। এটি হতে পারে চীনা অর্থনীতি সম্প্রসারণ। সেখানে পণ্য প্রস্তুতকরণ, উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে, যা চীনে ও বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে নেওয়া যেতে পারে।’
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত শর্মা ড. ইউনূসের মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, “বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মো. ইউনূস যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যকে স্থলবেষ্টিত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশকে তাদের (এসব রাজ্যের) সমুদ্রে প্রবেশাধিকারের অভিভাবক হিসেবে স্থান দেওয়া হয়েছে, যা আপত্তিকর ও তীব্র নিন্দনীয়। এই মন্তব্য ভারতের কৌশলগত ‘চিকেনস নেক’ করিডোর নিয়ে অব্যাহত দুর্বলতাকে তুলে ধরে।”
মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত শর্মা বলেন, চিকেনস নেক উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। অতএব, চিকেনস নেক করিডোর দিয়ে শক্তিশালী রেলওয়ে ও সড়ক যোগাযোগের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা অপরিহার্য। চিকেন নেক ছাড়াও উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযোগকারী বিকল্প সড়কপথেরও অনুসন্ধান করা জরুরি। যদিও এটি ব্যাপক প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জের বিষয়, তবুও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও উদ্ভাবন প্রচেষ্টার মাধ্যমে অর্জন সম্ভব।
হিমন্ত শর্মা আরও বলেন, মোহাম্মদ ইউনূসের এই ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্য হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়, কারণ এগুলো গভীর কৌশলগত জটিলতা ও দীর্ঘস্থায়ী এজেন্ডা তৈরি করতে পারে।
সর্ব ভারতীয় কংগ্রেস কমিটির (এআইসিসি) মিডিয়া ও প্রচার বিভাগের চেয়ারম্যান ও কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি সদস্য পবন খেরা বলেছেন, বাংলাদেশ ভারতকে অবরোধের জন্য চীনকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের এই পদক্ষেপ আমাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য খুবই বিপজ্জনক। সরকার মণিপুরের দিকে নজর রাখছে না। চীন অরুণাচল প্রদেশে একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেছে। আমাদের পররাষ্ট্র নীতি এতটাই শোচনীয় অবস্থায় যে, আমরা যে দেশটির সৃষ্টিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছি, সেই দেশটি এখন আমাদের ঘিরে ফেলার চেষ্টায় ব্যস্ত।’
প্রধানমন্ত্রী মোদির অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সঞ্জীব সান্যাল প্রশ্ন তোলেন, ড. ইউনূস কেন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কথা উল্লেখ করলেন। তিনি বলেন, ‘আশ্চর্যের বিষয় হলো, ভারতের সাতটি রাজ্য স্থলবেষ্টিত বলে ইউনূস চীনাদের কাছে প্রকাশ্যে আবেদন জানাচ্ছেন। চীনকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে স্বাগত জানানো হয়, কিন্তু এতে ভারতের সাতটি রাজ্য স্থলবেষ্টিত উল্লেখ করার তাৎপর্য ঠিক কী?’
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রিও ড. ইউনূসের বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য অত্যন্ত মর্মান্তিক। তার এ ধরনের বক্তব্য দেওয়ার কোনো অধিকার নেই। তিনি জানেন যে, উত্তর-পূর্বাঞ্চল (সেভেন সিস্টার্স) ভারতের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বঙ্গোপসাগরে উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রবেশাধিকার নিয়ে আমরা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে আলোচনা করেছি এবং এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক চুক্তিও রয়েছে।’
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ছন্দপতন ঘটে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে পরিকল্পিত গুজব ও উদ্দেশ্যমূলক খবর। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বহু ভুয়া খবরও প্রকাশিত হয়, যা নিয়ে ভারত সরকারের পক্ষ থেকেও উদ্বেগ করা হয়। কিন্তু, ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থাগুলো এসব খবরের সত্যতা পায়নি। সমীক্ষা প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিসটার এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, গত জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত সমীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ভুয়া খবর ছড়ায় ভারত। এসব ভুয়া খবরের রেশ ধরে দুই দেশের নাগরিকদের ভেতর বাড়ছে জাতিগত ঘৃণা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ।
এ ছাড়া চুক্তি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে গণহত্যা, গুমসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচারাধীন শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণে ঢাকার অনুরোধে সাড়া দেয়নি ভারত। তবে, চীন সফর শেষে দেশে ফিরে আসার একদিন পর ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও বাংলাদেশের জনগণকে চিঠি দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। চিঠিতে তিনি বলেন, ‘ঈদুল ফিতরের এই আনন্দময় মুহূর্ত উদযাপন, আত্মবিশ্লেষণ, কৃতজ্ঞতা ও ঐক্যের প্রতীক। এটি আমাদের করুণা, উদারতা ও সংহতির মূল্যবোধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যা আমাদের জাতিগুলোকে ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে আমাদের পরস্পরকে সংযুক্ত করে। এই পবিত্র দিন উপলক্ষে, আমরা সমগ্র বিশ্বের মানুষের শান্তি, সম্প্রীতি, সুস্বাস্থ্য ও সুখ-সমৃদ্ধি কামনা করি। আমাদের দেশগুলোর মধ্যকার বন্ধুত্বের বন্ধন আরও সুদৃঢ় হোক—এই প্রত্যাশা করি।’
এ ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসেও নরেন্দ্র মোদি শুভেচ্ছা বার্তা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে চিঠি পাঠান। এতে দুদেশের মধ্যে অংশীদারত্বকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ভারতের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরে বাংলাদেশের জন্য সাফল্যের পাল্লা ভারী। এ সময় উভয় দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার বিষয়ে একটি চুক্তি এবং আটটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। চীন সরকার ও চীনা কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বাংলাদেশ দুই দশমিক এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। এ ছাড়া পানি ব্যবস্থাপনায় বেইজিংয়ের কাছে ৫০ বছরের মহাপরিকল্পনা চেয়েছে ঢাকা।