ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্কের চাপে দিশেহারা ভারতীয় ব্যবসায়ীরা
মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৫
ফাইল ছবি
আন্তর্জাতিক ডেস্ক, সিএনএন বিডি ২৪.কম: মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া ভারতীয় পণ্যের ওপর মোট ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। এই শুল্ক আগামী ২৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে।
এতে ভারতের অর্থনীতির একটি বড় অংশ ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়েছে। মূলত, এই শুল্কের চাপেই ভারতীয় শিল্পকারখানাগুলো কার্যত ধুঁকছে এবং শ্রমিকদের বেতন দেওয়া নিয়েও দুশ্চিন্তায় পড়েছেন উদ্যোক্তারা।
মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তামিলনাড়ুর তিরুপ্পুরে একটি তৈরি পোশাক কারখানায় অস্বাভাবিক নীরবতা বিরাজ করছে। ভারতের অন্যতম বৃহৎ টেক্সটাইল রপ্তানি কেন্দ্র এই শহর একসময় মুখর ছিল সেলাই মেশিনের শব্দে। কিন্তু এন কৃষ্ণমূর্তির কারখানায় এখন ২০০টি মেশিনের মধ্যে সামান্য কিছু চালু আছে। মার্কিন বাজারে শিশুদের পোশাকের শেষ অর্ডারগুলো শেষ করছেন শ্রমিকরা।
কোণায় পড়ে থাকা নতুন ডিজাইনের কাপড়ের নমুনাগুলোয় জমেছে ধুলো। কারণ, বুধবার থেকে কার্যকর হতে যাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসনের ৫০ শতাংশ শুল্ক, যা ভারতের রপ্তানিতে বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
ভারত যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক, চিংড়ি, রত্ন ও গয়নার অন্যতম বড় রপ্তানিকারক। বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এই শুল্ক কার্যত ভারতীয় পণ্যের ওপর এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা। এর পাশাপাশি রাশিয়ার কাছ থেকে তেল ও অস্ত্র কেনার জন্য অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
বিবিসির সংবাদদাতারা ভারতের বিভিন্ন রপ্তানি কেন্দ্র ঘুরে দেখেছেন এবং দেখেছেন এই অনিশ্চয়তা কীভাবে ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের জীবন ও জীবিকায় প্রভাব ফেলছে।
তিরুপ্পুর থেকে ওয়ালমার্ট, টার্গেট, গ্যাপ ও জারার মতো মার্কিন ব্র্যান্ডে বছরে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়, যা ভারতের মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির এক-তৃতীয়াংশ। সেখানে এখন গভীর উদ্বেগ বিরাজ করছে।
কৃষ্ণমূর্তি বলেন, সেপ্টেম্বরের পর থেকে হয়তো করার মতো কিছুই থাকবে না। অর্ডার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি সম্প্রসারণ পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন এবং সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ২৫০ শ্রমিককে বসিয়ে রাখতে হয়েছে।
শুল্ক ঘোষণার সময়টাও রপ্তানিকারকদের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর হয়েছে। কারণ, বছরের অর্ধেক বিক্রি হয় বড়দিন ঘিরে এই মৌসুমে। এখন তারা নির্ভর করছেন স্থানীয় বাজার ও আসন্ন দীপাবলি মৌসুমের ওপর।
অন্যদিকে এক অন্তর্বাস প্রস্তুতকারকের কারখানায় প্রায় ১০ লাখ ডলারের পণ্য মজুত রয়েছে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর মতো ক্রেতা নেই। রাফট গার্মেন্টসের মালিক শিব সুব্রামানিয়াম বলেন, আমরা আশা করেছিলাম যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি হবে। কিন্তু গত মাস থেকে পুরো উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে শ্রমিকদের বেতন দেব কীভাবে?
৫০ শতাংশ শুল্কের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে ১০ ডলারের ভারতীয় শার্ট বিক্রি হবে ১৬.৪ ডলারে। অথচ একই পণ্য চীন থেকে আসে ১৪.২, বাংলাদেশ থেকে ১৩.২ আর ভিয়েতনাম থেকে ১২ ডলারে। এমনকি শুল্ক ২৫ শতাংশে নামলেও ভারত প্রতিযোগিতায় পিছিয়েই থাকবে।
ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে ভারত সরকার কাঁচামালের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারসহ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। বিকল্প বাজার খুঁজতে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনাও জোরদার করা হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীদের দাবি, পদক্ষেপগুলো এসেছে অনেক দেরিতে।
গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, আমরা বাণিজ্যের মোড় ঘুরে যেতে দেখব। মার্কিন ক্রেতারা চলে যাবে মেক্সিকো, ভিয়েতনাম কিংবা বাংলাদেশে।
এদিকে মুম্বাইয়ের রপ্তানি অঞ্চলে শত শত শ্রমিক হীরার পাথর মসৃণ ও প্যাকেজিং করছেন। ভারতের ১০ বিলিয়ন ডলারের রত্ন ও গয়না রপ্তানির বড় অংশই যুক্তরাষ্ট্রে যায়। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ৩-৪ বিলিয়ন ডলারের গয়না রপ্তানি হয়ে থাকে। কিন্তু এখন শুল্কের কারণে বিক্রি কমে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ক্রিয়েশন জুয়েলারির আদিল কোটওয়াল, যার ৯০ শতাংশ হীরা সংবলিত গয়না যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হয়। তিনি বলেন, আমাদের লাভের হার মাত্র ৩-৪ শতাংশ। ১০ শতাংশ বাড়তি শুল্কও আমরা বহন করতে পারব না। এমনকি মার্কিন খুচরা বিক্রেতারাও এই বোঝা টিকিয়ে রাখতে পারবে না।
হীরা আসে গুজরাটের সুরাট থেকে। কিন্তু সেখানকার কারখানাগুলো আগেই সংকটে ছিল—চাহিদা কমে যাওয়া ও ল্যাব-গ্রো করা হীরার প্রতিযোগিতার কারণে। নতুন শুল্কে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
প্রায় ৫০ লাখ মানুষের জীবিকা নির্ভরশীল এই খাতে এখন মাসে গড়ে মাত্র ১৫ দিন কাজ হচ্ছে। অনেক চুক্তিভিত্তিক শ্রমিককে অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। সুরাটের এক কারখানা মালিক শৈলেশ মাঙ্গুকিয়া বলেন, আগে যেখানে ৩০০ শ্রমিক ছিল, এখন মাত্র ৭০ জন। মাসে যেখানে ২ হাজার হীরা পালিশ করা হতো, এখন তা নেমে এসেছে ৩০০টিতে।
স্থানীয় ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ভবেশ ট্যাঙ্ক বলেন, শ্রমিকদের আয় কমছে, অনিচ্ছাকৃত ছুটি বাড়ছে, মাসিক বেতন ক্রমেই কমছে।
ভারতের চিংড়ি খামারিরাও বড় ক্ষতির মুখে। বিশ্বে অন্যতম বড় চিংড়ি রপ্তানিকারক দেশ ভারত, যার প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র। নতুন শুল্কের ফলে এই খাতে মোট শুল্ক ৬০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। ইতোমধ্যে দামও কমে গেছে কেজিপ্রতি ৬০-৭২ সেন্ট এবং আরও কমার আশঙ্কা রয়েছে।
দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশের এক রপ্তানিকারক ঠোটা জগদীশ বলেন, এটাই আমাদের মৌসুম। বড়দিন ও নববর্ষ উপলক্ষে মার্কিন ক্রেতারা এই সময়ে অর্ডার দেয়। কিন্তু শুল্কের কারণে এখন আমরা কিছুই নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না।
অনেক হ্যাচারি ইতোমধ্যে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। ভীরাবাসারামের এমএস বর্মা বলেন, আগে আমরা বছরে ১০ কোটি লার্ভা উৎপাদন করতাম। এখন ৬-৭ কোটি ছুঁতেও পারছি না।
এমন পরিস্থিতিতে এই খাতে সরাসরি পাঁচ লাখ এবং পরোক্ষভাবে ২৫ লাখ মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই সংকট আবার এমন সময় এসেছে, যখন ভারতে কর্মসংস্থানের পরিস্থিতি আগেই উদ্বেগজনক।
মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যকার বাণিজ্যিক অচলাবস্থা এখনো কাটেনি। বরং সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে আলোচনার পরিবেশ আরও খারাপ হয়েছে। দিল্লিতে নির্ধারিত নতুন বাণিজ্য আলোচনা বাতিল হয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তারা ভারতকে ‘চীনের ঘনিষ্ঠ’ এবং ‘রাশিয়ার মানি লন্ডারিংয়ের জায়গা’ বলেও মন্তব্য করেছেন।
এশিয়া গ্রুপ অ্যাডভাইজরির গোপাল নাদ্দুর বলেন, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার ভবিষ্যৎ এখন অনেকটাই নির্ভর করছে ট্রাম্প প্রশাসনের অগ্রাধিকারের ওপর, যার মধ্যে ঘরোয়া রাজনীতি ছাড়াও রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
তিনি আরও বলেন, ভারতের নীতিনির্ধারক ও ব্যবসায়ীদের জন্য এখন মূল মন্ত্র হলো, আত্মনির্ভরতা বাড়াও, বাজার বৈচিত্র্য করো এবং কোনো সুযোগ হাতছাড়া করো না।