আজ
বুধবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৪ ||
১৫ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ বুধবার, ১১:০৭ অপরাহ্ন
১৬ ডিসেম্বরতো পেলাম ভূখণ্ড শাসনের ক্ষমতা! আমি কতটা স্বাধীন?
বৃহস্পতিবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২১
মো: ওবায়েদ উল্যাহ ভূলন: স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছর। মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় বিজয়ের পঞ্চাশ বছর অতিক্রম করছি আমরা।
দীর্ঘ ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে অগণিত রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষের জীবন উৎসর্গের মধ্য দিয়ে এই জাতিকে অগ্রসর হতে হয়েছে। বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার লক্ষ্য পূরণের অভিপ্রায়, অবিচার ও শোষণ থেকে মুক্তি এবং জাতিগত অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার সেই লড়াই নিষ্কণ্টক ছিল না। অসংখ্য নেতাকর্মীর কারাবরণ, পাকিস্তানি সামরিক সরকারের নির্যাতন নিগ্রহের শিকার হয়েও দমে না যাওয়া, বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে আমাদের প্রত্যয়দৃঢ় পূর্বসূরি রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে অর্জন, পৃথিবীর ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। একটি নিরস্ত্র জাতিকে প্রগাঢ় দেশপ্রেমের দীক্ষা দিয়ে সশস্ত্র ও সুসংগঠিত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার যে মানসিক শক্তি ও দিকনির্দেশনা দিতে পেরেছিলেন, তৎকালীন বিশ্ববাসীকে তা বিস্মিত করেছিল। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান ও দুই লক্ষ নির্যাতিত মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর যন্ত্রণা বুকে নিয়ে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে এই বাংলাদেশের যাত্রা শুরু। আজ বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীতে অবনত মস্তকে হৃদয়ের গভীর থেকে শ্রদ্ধা জানাই মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদের প্রতি। গভীর শ্রদ্ধা জানাই সকল নির্যাতিত নারীদের প্রতি। যে মা তার সন্তানকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন, যে মা সন্তান হারানোর তীব্র ব্যথা বুকে নিয়ে আমৃত্যু কেঁদে গেছেন। যে পিতা সজ্ঞানে দেশমাতৃকার জন্য তাঁর পুত্রকে উৎসর্গ করেছিলেন, যে স্ত্রী তার স্বামী হারানোর যন্ত্রণা আজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন, যে বোন তার স্নেহশীল প্রিয় ভাইকে হারিয়েছেন- তাদের সকলের যন্ত্রণার বেদীমূলে এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্ম।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করেছি। স্বাধীনতা পেয়েছি। কে আমাদের সেই স্বাধীনতা দিল? স্বাধীনতা কি কেউ কাউকে দেয়? গচ্ছিত ধনের মতো অবয়ব ও ওজনদার কোনও বস্তু কি এই স্বাধীনতা?
নাকি স্বাধীনতা একটি নির্ধারিত পরিসরে,কিছু বিধিবন্ধন সাপেক্ষে তার অস্তিত্ব! স্বাধীনতা আসলে ঠিক কী! স্বেচ্ছাকৃত সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাই কি স্বাধীনতা? প্রতিষ্ঠান যে সিদ্ধান্ত নেয়, তার পশ্চাতে থাকে মানুষের নিজস্ব ব্যক্তিক বা গোষ্ঠীগত ইচ্ছার প্রকাশ! তা যেমন নির্বাধ হতে পারে না, তেমনই ব্যক্তির আত্মঘাতের মতো স্বেচ্ছা সিদ্ধান্তকেও আমরা স্বাধীনতার অধিকার হিসেবে মেনে নিতে পারি না। সুতরাং ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যাই হোক, স্বাধীনতাকে একটা খোলা মাঠের সঙ্গেও তুলনা করা যায়, যার সীমা আছে। আবার পরিসরও আছে।
স্বাধীনতা আসলে সেই আশ্চর্য পুতুল, যে মেলায় ঘুরে ঘুরে খেলা যখন দেখায়, আলো-আঁধারিতে তার নড়াচড়া স্বেচ্ছাকৃত মনে হয় এবং দর্শক এক কাহিনীর মধ্যে ঢুকে পড়েন। সেই পুতুলের প্রত্যেকটি নড়াচড়া তৈরি হয় অন্তরালে বসে থাকা কোনও ব্যক্তির হাতে বাঁধা সুতোর টানে। আপাতদৃষ্টিতে যা চোখে পড়ে না।
এখানে সুতো নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি প্রতীক মাত্র। তার জায়গায় আমরা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বসিয়ে দিতে পারি, সমাজ, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং জাতীয় ঋণ বা গড় জাতীয় আয়কেও বসিয়ে দিতে পারি। এমনকী, রাষ্ট্রপরিচালনাকারী দল প্রেম-প্রণয় বিষয়ে কোন নীতি বিশ্বাস করে, তাই দিয়েও স্বাধীনতার সুতো তৈরি করা যায়।
তা হলে ১৬ ডিসেম্বর আমরা কী পেলাম? সে দিনের সেই স্বাধীনতার নাম আসলে ক্ষমতার হস্তান্তর। বাংলাদেশ ভূখণ্ড শাসনের ক্ষমতা। এক রাষ্ট্রের জন্ম, যে রাষ্ট্র সম্পর্কে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারবে সেই ভূখণ্ডজাত মানুষ। সুদীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের লড়াকু মানুষ এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করেছিল, আমাদের দেশ আমরাই শাসন করতে চাই। এরই নাম স্বাধীনতা।
এই স্বশাসিত হবার ক্ষমতাই কী ‘স্বাধীনতা’? আমরা কি সেদিন দেশ সম্পর্কিত বোধ, স্বাধীনতার ধারণা, ন্যায়-নৈতিকতা বিষয়ে উত্থাপিত প্রশ্নগুলো নির্দিষ্ট গ্রহণযোগ্য উপসংহারে পৌঁছতে পেরেছিলাম? সদ্যপ্রসূত দেশের প্রতিটি কোণায় গর্ব, আবেগ এবং দেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে যখন পতাকা উড়ছিল তখন শরণার্থী শিবির থেকে কোটি কোটি মানুষ নিঃসম্বল অবস্থায়, চোখের জলে ভাসতে ভাসতে যখন স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, তাদের সেই ভেঙে যাওয়া স্বপ্নগুলোর পুনঃনির্মাণে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল কী?
স্বাধীনতা কি ব্যক্তির? ব্যক্তি মানে তো তার মননেরও। আপাত আধুনিক, ফ্যাশনদুরস্ত যে তরুণ-তরুণীটি একই সঙ্গে বিজ্ঞান ও জ্যোতিষে মগ্ন সে-ও কি সংস্কারের কাছে অনৃত্যের কাছে বন্দী নয়? তার স্বাধীনতা কবে আসবে? আসলে স্বাধীনতার কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা হয় না। নানা ভাবে আমরা বন্দি। ব্যক্তি সম্পর্কই বলুন বা সামাজিক বিধি-নিষেধই বলুন, আমাদের নানা বাঁধন। নানা লাল চোখ সব সময় আপনাকে পাহারা দিচ্ছে। আর এখন তো কে কী খাবে না খাবে, পরবে না পরবে, কি বিশ্বাস করবে না করবে, তা নিয়েও আসছে নানা ফতোয়া। তা ছাড়া নন্দনতত্ত্ব, সাহিত্য, বিজ্ঞান, চিত্রকলা, নাটক, ভাস্কর্য, সিনেমার যেমন কোনও নির্দিষ্ট ভূগোল নেই। সে অনন্ত আকাশে পাখির মতোই সর্বত্রগামী, স্বাধীনতার আসল রূপটিও তাই। সীমান্তে কাঁটাতার, রাইফেল, সতর্কতা সব পেরিয়েও তাই লোকে এ পার-ও পার করে। স্বজনের টানে, অর্থনৈতিক তাগিদেও।
রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা নাগরিকের জীবন এবং ভূখণ্ড রক্ষা করে। সেই ভূখণ্ড দেশ, সেই নাগরিকবৃন্দও দেশ। সেই দেশের মধ্যে আছে সমাজ, ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতি। আছে নিয়ত বিবর্তনশীল মানবিক সত্তা। যা সমাজের প্রতিটি দিক, প্রতি ব্যবস্থা এবং ব্যক্তি মানুষের নৈতিকতা ও আচরণবিধির মধ্যে পরিবর্তন ঘটায়।
অর্থাৎ, দেশ সম্পর্কে ধারণার মধ্যে রাষ্ট্র সর্বত্র প্রবেশাধিকার পায় না। কারণ রাষ্ট্র সম্যক বিধি ও নিয়মকানুন তৈরি করে শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারে। সেটা বাইরের কাজ। বোধ ও বিশ্বাসে তার হাত নেই। সেখানে চিত্তবৃত্তির স্বাধীনতা। আর এখান থেকেই জন্ম নেয় ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণা।
একজন ব্যক্তি প্রাথমিকভাবে একজন একক সত্তা। তারপর সে সামাজিক সত্তা। এরপর সে এক রাষ্ট্রীয় পরিচিতি, যাকে আইডি কার্ড, পাসপোর্ট দিয়ে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু সেই ব্যক্তি ছবি আঁকবে কিনা, গান গাইবে কিনা, আমিষ ভোজন করবে কিনা, ঈশ্বরে বিশ্বাস করবে কিনা ইত্যাদি বহুতর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনও ভূমিকা থাকে না। বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী সমাজও তার নিয়ন্ত্রণক্ষমতা হ্রস্বতর করেছে। শক্তিশালী হয়ে উঠেছে ব্যক্তিস্বাধীনতা বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ।
অর্থাৎ, একজন ব্যক্তির সাপেক্ষে স্বাধীনতা বর্তমানে ত্রিস্তরীয় কাঠামো। ব্যক্তি, দেশকাল সাপেক্ষে সমাজ, সমষ্টিগত ভাবে ব্যক্তি ও সমাজ সাপেক্ষে রাষ্ট্র।
রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে প্রত্যেক নাগরিকের গুরুত্ব সমান। কারণ রাষ্ট্র নৈর্ব্যক্তিক। একটি কাঠামো মাত্র। দেশবাসীর অধিকারগুলি সুরক্ষিত করার বিধিবন্ধন। সমাজের প্রয়োজনে নিয়ম সৃষ্টি করা হয়, সমাজ তার রক্ষক সৃষ্টি করে, শৃঙ্খলার নির্ণায়ক এবং পরিচালক। তাকে আমরা বলছি ‘সরকার’ বা গভর্নমেন্ট। যে পরিকাঠামো অবলম্বন করে শাসনপ্রক্রিয়া চালায় ‘সরকার’ সেই হল রাষ্ট্র। প্রত্যেক নাগরিক রাষ্ট্রের অধীন, এবং রাষ্ট্রের অংশ। রাষ্ট্র নাগরিকবৃন্দের স্বাধীনতা, জীবন, অধিকার এবং নিরাপত্তার রক্ষক। অর্থাৎ দেশ ও দেশবাসীর জীবনের ও স্বাধীনতা রক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান।
অনেক সময় রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠান স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতো নাগরিক অধিকার হরণ করতে থাকে। অর্থাৎ, এই দেশেরই কতিপয় নাগরিক, যারা শাসনপ্রণালির পরিচালক, ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু করেন, সেই মুহূর্তে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব আর স্বাধীন থাকতে পারে না। রাষ্ট্রীয় নীতি, সর্বজনস্বীকৃত সংবিধান ও আইন একটি মৌলিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, তা হল মানবিক সততা। যে মুহূর্তে কোনও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়, রাষ্ট্রের স্বাধীন সত্তার অপব্যবহার ঘটতে থাকে, নাগরিকবৃন্দও আর স্বাধীন থাকেন না। তখন আসে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ। অধিকার বোধের সঙ্গেই তাদের উদ্ভব। কারণ স্বাধীনতা মানে কেবল শাসন প্রক্রিয়ার ক্ষমতা হস্তান্তর নয়, স্বাধীনতা একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া যা সচেতন নাগরিককে অর্জন করে চলতে হয়।
স্বাধীন দেশে আমরা ভোটাধিকার পাই এবং শাসনকার্যের প্রতিনিধি নির্বাচন করি। আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশচালনার যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু শুধুমাত্র ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নাগরিকের কর্তব্য শেষ হয় না। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে নজরদারিও তার নিজের অধিকারকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে। এই চেতনা যত বেশি করে উৎসারিত হয়, তত সমাজের মঙ্গল, দেশের মঙ্গল।
রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের সীমা কতদূর, নাগরিক সমাজের তা ভুললে চলে না, ব্যক্তিজীবনে সমাজের নাক গলানোর অধিকার বহির্ভূত হচ্ছে কিনা তা-ও নাগরিক সচেতনতাই নির্ধারণ করে।
কর্তব্যের অঙ্গীকারে স্বাধীনতা প্রতি মুহূর্তে অর্জন করতে হয়, প্রতি ক্ষেত্রে, জীবনে এর চেয়ে বৃহৎ সত্য আর কিছু নেই।
৫০ বছর হয়ে গেলো স্বাধীনতা পেলাম কিন্তু বাস্তবে কতটা স্বাধীন আমরা ? নাকি পরাধীনতার নাম পরিবর্তন হয়েছে মাত্র ! আমি কি আমার ভোট দিতে পারি ? না তার কোন মূল্য আছে ! ৭১ এর মত আমি আজও রাস্তায় দাড়িয়ে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারি না । ৭১ এ পাক সেনাবাহিনী পেটাত আজ পুলিশ পেটায় । ৭১ এ চাকুরীতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রাধান্য ছিলো আজ নির্দিষ্ট একটি গোষ্টির। ৭১ এ দেশের আয়ের বড় অংশ পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে ব্যয় হত আর এখন সরকারী দল ও আমলাদের পকেট উন্নয়নে । আজও আমাদের গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে হয় । দেশে যে এখন স্বীকৃত একনায়কতন্ত্র চলছে যা অস্বীকার করার উপায় নেই । আমি দেশের বৃহত্তম অংশ আমার অবস্থার কি উন্নতি হয়েছে? আমি কতটা স্বাধীন ?