ভোটের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে দুদলের মধ্যে চ্যালেঞ্জ-পালটা চ্যালেঞ্জ বাড়ছে। সম্প্রতি সব ছাপিয়ে আবারও আলোচনায় চলে আসছে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী বছরের শেষে কিংবা ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ওই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি এবং সমমনা বাম, ডান, কিছু কিছু নামধারী বাম যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করে আগামী নির্বাচন করতে জোট বাঁধছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য বিএনপির নেতৃত্বে যেসব দল ও জোট এক কাতারে শামিল হতে যাচ্ছে তারা শেখ হাসিনার সরকারকে আগে পদত্যাগ করার দাবি জানাচ্ছে। পরে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের মাধ্যমে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার লক্ষ্যে সংগঠিত হচ্ছে।
এখনো বিএনপি এককভাবে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে দলীয় নেতাকর্মীদের দ্বারা সমাবেশ ও মিছিল সংগঠিত করার পর্যায়ে রয়েছে।
বিএনপি এই সভা-সমাবেশগুলোতে মূলত লোড শেডিং, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদির প্রতিবাদের পাশাপাশি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ের জন্য দেশে গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টি করার ঘোষণা দিচ্ছে। অবশ্য অনেক জায়গায়ই বিএনপির এসব সভা-সমাবেশ ও মিছিল পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাধার মুখে পড়ছে। কোথাও কোথাও সংঘর্ষও হচ্ছে। অন্য ছোট রাজনৈতিক দলগুলো এখনো মাঠে নেই। তাদের কোনো কোনোটিকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভেতরে আলোচনা অনুষ্ঠান, বাইরে মানববন্ধন করতে দেখা যাচ্ছে। তবে ওই সব রাজনৈতিক ছোট দল ও জোটের অবস্থান এখনো স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। বড় দল হিসেবে বিএনপি দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংগঠিত হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। নেতাকর্মীদের মধ্যে লড়াকু মনোভাবও দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়াকে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষেরই কেউ না কেউ আহত হচ্ছেন।
বিএনপির আন্দোলন এখনো কিছু সংঘাত-সংঘর্ষে আক্রান্ত হলেও তাদের কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। বিএনপির নেতাকর্মীদের ধারণা, তাঁরা বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাবে বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং জ্বালানি তেলের সংকটের ইস্যুকে কেন্দ্র করে জনসাধারণকে তাদের আন্দোলনে যুক্ত করতে পারবে। অবশ্য এরই মধ্যে লোড শেডিং কমে যাওয়ায় হারিকেন মিছিল মোমবাতি প্রজ্বালনে নেমে এসেছে। দ্রব্যমূল্য সরকারের পক্ষে কতটা কমানো সম্ভব হবে সেটি অবশ্য জটিল প্রশ্ন। কারণ এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ও মুদ্রাস্ফীতি। যার প্রভাব থেকে বাংলাদেশ মুক্ত নয়। সুতরাং এই ইস্যুতে আন্দোলন করা গেলেও এটিকে শেখ হাসিনার সরকার পতনের আন্দোলনে রূপান্তর করা আদৌ সম্ভব হবে কি না সেটি একটি জটিল বিষয়।
দলীয় সরকার নাকি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে-এ ইস্যুতেই আবারও দুদল ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’ অবস্থায় চলে যাচ্ছে কিনা-সেই প্রশ্ন ও আশঙ্কা সব মহলে।
আরেকবার ২০১৪ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তির ক্ষেত্রও তৈরি হতে পারে। এর থেকে উত্তরণের পথ রাজনীতিকদের হাতেই রয়েছে। এজন্য প্রয়োজন পারস্পরিক সমঝোতা। দল দুটি নিজেদের অনড় অবস্থান থেকে সরে এলেই এ সমস্যার সমাধান হতে পারে।
সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশনও এক্ষেত্রে উদ্যোগ নিতে পারে। যদিও প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বারবার বিষয়টি রাজনীতিকদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেবে না বলেও জানিয়েছেন।
এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সহিংস ঘটনা ঘটেনি। তবে সামনে এ ধরনের পরিস্থিতি যে আসবে না, তা বলা যাবে না। নাগরিক হিসাবে আমার প্রত্যাশা, দুদলই কিছু ছাড় দিয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছবে। যদিও এ প্রত্যাশা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা খুবই কম। এর বড় উদাহরণ হচ্ছে, অতীতে জাতিসংঘ ও কমনওয়েলথের উচ্চপদস্থ দুজন কর্মকর্তা বাংলাদেশে এসে দুদলের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করেছিলেন। দুবারের ওই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছিল। এবারও রাজনীতিকরা যদি নিজেদের মধ্যে সমঝোতা না করেন তাহলে আমার আশঙ্কা হচ্ছে সামনে সংঘাতের দিকে যাচ্ছে দেশ। এতে একদিকে দেশে অস্থিরতা তৈরি হবে, অন্যদিকে দ্রব্যমূল্য বেড়ে আরও নাভিশ্বাস হবে।
নির্বাচনের জন্য অল্প সময় বাকি থাকলেও রাজনৈতিক সমঝোতা হলে তা আইনে রূপ দেওয়া কঠিন নয়। এমনকি রাজনীতিকরা রাজি হলে সংবিধানের ভেতরে থেকেই বা সংবিধান সংশোধন করেও সমঝোতার পথ বের করা সম্ভব। তবে দুদলের যে অবস্থান সমঝোতার পথ খুঁজছেন বলে মনে হচ্ছে না।
সংবিধান অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজনে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আগামী বছরের শেষ অথবা ২০২৩ সালের শুরুতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে আসছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে রাজনীতিতে পালটাপালটি বক্তব্য দীর্ঘদিন ধরেই দিয়ে আসছেন দুদলের নেতারা। সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত বিএনপির মহাসমাবেশগুলোতে নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে জোরালো বক্তব্য দিয়েছেন দলটির নেতারা। অপরদিকে আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর কখনও বাংলাদেশে আসবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই বিএনপি নির্বাচনে আসবে। আর বিএনপি না এলেও সংবিধান মোতাবেক যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দুদলই এ ইস্যুতে সামনের কর্মসূচি জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি বর্জন করেছিল। আর ২০১৮ সালের নির্বাচন অংশ নিলেও মাত্র ছয়টি আসন পায়। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি এবার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে কোনোভাবেই না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও ক্ষমতাসীন দলের তরফে বলা হচ্ছে, নির্বাচনে অংশ নিতে তলে তলে বিএনপি প্রস্তুতি নিচ্ছে। আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে বলেও দাবি করছে দলটি।
নির্বাচন ইস্যুতে দুদলই নো রিটার্ন পয়েন্টে চলে গেছে। যে কোনো মুহূর্তে সংঘাতে রূপ নেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দেশের যে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি তাতে সরকার আগের মতো কঠিন অবস্থানে থাকতে পারবে না। এ কারণে বিএনপিও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে দেবে না-এটাই এখন প্রতীয়মান। বিএনপির কয়েকটি আন্দোলনে পুলিশকে মারমুখী আচরণ করতে দেখা গেছে। তবে মহাসমাবেশগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধা দেওয়ার তেমন ঘটনা দেখা যায়নি। সরকার সমর্থিত পরিবহণ নেতারা গাড়ি ধর্মঘটসহ বিভিন্নভাবে মহাসমাবেশ বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছে। তাতে লাভ হয়নি। সুতরাং একতরফা নির্বাচন হবে এমনটা আশা করা যায় না।
দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেশে প্রশ্ন রয়েছে। নির্বাচনের সময়ে ক্ষমতায় থাকা সরকারকে নিরপেক্ষ ও স্বার্থের দ্বন্দ্বমুক্ত হতে হবে। নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া কোনো দেশে গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। বাংলাদেশেও সম্ভব নয়।
সেটি করতে হলে সরকারি দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতেই হবে। সেখানে কোনো বিশেষ দলের জয়-পরাজয় নয়; বরং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে করণীয় সব উদ্যোগ বিবেচনায় নিতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে, নির্বাচনকালীন সরকারও কোনোভাবেই বিতর্কে জড়ানোর মতো কাজ করবে না—এমন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হবে। এই পথ ছাড়া অন্য পথে নির্বাচনের কথা ভাবতে গেলেই দেশে সংঘাত ও হানাহানি যেমন বাড়বে, একই সঙ্গে নির্বাচনী ব্যবস্থা আরো ভেঙে পড়বে। সে ক্ষেত্রে দেশে নৈরাজ্য, হানাহানি এবং প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর কর্তৃত্ব গোটা রাজনীতিতে ছড়িয়ে পড়বে।