আজ
বুধবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৪ ||
১৫ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ বুধবার, ১১:০৭ অপরাহ্ন
বাংলাদেশের অধুনালুপ্ত শাসন ব্যবস্থা!
বুধবার, ০১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
মো: ওবায়েদ উল্যাহ ভূলন: বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশের অধুনালুপ্ত একপ্রকারের শাসন ব্যবস্থা, যার অধীনে দুইটি নির্বাচিত সরকারের মধ্যবর্তী সময়কালে সাময়িকভাবে অনির্বাচিত ব্যক্তিবর্গ কোন দেশের শাসনভার গ্রহণ করে থাকে। সাধারণত নির্বাচন পরিচালনা করাই এর প্রধান কাজ হয়ে থাকে।
২০১১ সালের ১০ মে বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় দেয়। এছাড়াও বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ সরকার ব্যবস্থাকে বাতিল করা হয়।
বাংলাদেশের সংবিধানের সংশোধনী অনুসারে দুই নির্বাচনের মধ্যকার সময়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৩ মাসের জন্য ক্ষমতা গ্রহণ করে। এসময় সুপ্রিম কোর্ট হতে সর্বশেষ অবসর গ্রহণকারী প্রধান বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তাকে এক দল নিরপেক্ষ উপদেষ্টামণ্ডলী সাহায্য করে থাকে। তবে এসময় সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব রাষ্ট্রপতির হাতে থাকে। রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের রূপরেখা দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। রূপরেখার শেষ বাক্যে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের এই রূপরেখা অধিকতর সমৃদ্ধ করিতে আপনাদের গঠনমূলক পরামর্শ জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে আমরা সাদরে গ্রহণ করিব। এক শব্দে বর্ণনা করতে চাইলে বলতে হবে, রূপরেখাটি ‘সুলিখিত’। অল্প কিছু পরিবর্তনসহ বাস্তবায়ন করা গেলে এই রূপরেখা ভালো ফল দিতে পারে। শুরুতে ভূমিকায় বলা হয়েছে, দেশের জনগণের হাতেই দেশের মালিকানা ফিরাইয়া দেওয়ার লক্ষে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে জয়লাভের পর বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকার হটানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলসমূহের সমন্বয়ে একটি ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা হইবে। উক্ত ‘জাতীয় সরকার’ নিম্নলিখিত রাষ্ট্র রূপান্তরমূলক সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করিবে:…।
দেশে যে “অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন” অনুষ্ঠিত হবে, রূপরেখার প্রণয়নকারীরা সেটা কিসের ভিত্তিতে ধরে নিয়েছেন তা স্পষ্ট নয়। একই বাক্যে নিশ্চিত করা হয়েছে যে ‘ফ্যাসিস্ট সরকার’ হটানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলসমূহ নির্বাচনে জয়লাভ করবে। এই সিদ্ধান্তমূলক ধারণা রুপরেখায় থাকা উচিত নয়।
একটা গল্প দিয়ে শুরু করা যাক: যুদ্ধে হেরে যাবার পর সেনাপতি রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেছেন। রাজার দরবারে এ বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য সেনাপতিকে ডাকা হলো। রাজা সেনাপতিকে যুদ্ধে হারার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। সেনাপতি বললেন, যুদ্ধে হারার ৩৩ টি কারণ চিহ্নিত করা গেছে, মহারাজ। প্রথম কারণ, বন্দুক ও কামান ছিল; কিন্তু গুলি ও গোলা ছিল না। দ্বিতীয় কারণ…রাজা সেনাপতিকে থামিয়ে দিয়ে বললেন আপনি থামুন; বাকি ৩২টি কারণ আর বলার দরকার নেই।
রূপরেখার ২ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে সকল মত ও পথের সমন্বয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক ‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠা করা হইবে। এই জন্য অব্যাহত আলোচনা, মতবিনিময় ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎমুখী এক নতুন ধারার সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছাইতে হইবে। এজন্য একটি ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন করা হইবে।’ অন্তর্ভুক্তিমূলক ‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া এবং আওয়ামী লীগের মতো বৃহৎ রাজনৈতিক দলকে তার বাইরে রাখার চিন্তা পরস্পরবিরোধী।
বিএনপির এই রূপরেখায় ২৭টি দফা আছে। শুধু ২ নম্বর দফাটি বাস্তবায়ন করা গেলে বাকি ২৬টি বাস্তবায়নে আর কোনও বাধা থাকবে না। আর এটি বাস্তবায়ন করা না গেলে বাকিগুলো বাস্তবায়নের কোনো সুযোগ নেই। ব্যাপারটা অনেকটা উপরের গল্পের যুদ্ধেগুলো শেষ হয়ে যাওয়ার মত। রূপরেখাটির বড় ত্রুটি হলো, এতে বিএনপি ধরে নিয়েছে যে, দেশে একটি অবাধ নির্বাচন হবে এবং তাতে তারা জয়লাভ করবে। নিকট অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, এরকম আশা করা বোকামি। বৈরিতার অবসান না হলে সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা খুব-ই কম। আগামী সংসদ নির্বাচন আসতে এখনও এক বছর বাকি। ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ এখন-ই গঠন করে শুধু ২ নম্বর ধারাটি বাস্তবায়ন করা গেলে একটা অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হতে পারে এবং নির্বাচনের পর জাতীয় সরকার গঠন ও কল্পিত ‘রেইনবো নেশন’ গঠন করা সম্ভব হতে পারে। তখন বাকি ২৬টি ধারা বাস্তবায়ন করবে নির্বাচন পরবর্তী জাতীয় সরকার। বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের মূল কারণ নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়া নয় বরং এটা বেশ কিছু বৈরিতা, বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসামূলক ঘটনার উপজাত। শুধু একটা সুষ্ঠু নির্বাচন করা গেলেই যে সংকটের সমাধান হবে না এই সহজ সত্যটি বিএনপি স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করেছে বলেই দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে রূপরেখাটি জাতির সামনে হাজির করেছে। আমার মতে, ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ এর প্রথম কনভেনশন হতে হবে শুধু বিএনপির রূপরেখায় উল্লেখিত ২ নম্বর ধারাকে ভিত্তি করে।
সেখানে, ইতিহাসবিদ, শিক্ষাবিদ, আইনজ্ঞ, গণমাধ্যম ও প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা থাকবেন। সপ্তাহ বা পক্ষকালব্যাপী (মাসব্যাপীও হতে পারে) আলোচনায় শুধু সেই বিষয়গুলো থাকবে যা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব তৈরি করেছে। যেমন, ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর ও ২১ আগস্টের হত্যাকান্ড, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি, বাকশাল, রক্ষীবাহিনী, গণবাহিনী, সামরিক শাসন (’৭৫- ’৯০), যুদ্ধাপরাধের বিচার, ২০১৪, ১৮-র নির্বাচন— এসব বিষয়ে দলগুলো তাদের ব্যাখ্যা ও বর্তমান অবস্থান উপস্থাপন করবে। রাজনৈতিক দলগুলো এবং অন্য সবগুলো পক্ষ এই ঘটনাপ্রবাহে তাদের দায় স্বীকার করে ভবিষ্যতে সকল পক্ষের প্রতি সৎ থাকার অঙ্গীকার করলে একটা আস্থার পরিবেশ তৈরি হতে পারে। ‘প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতি’ থেকে মুক্তি পেতে ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ প্রথম কনভেনশনে যে কয়টা বিষয় বিবেচনায় নিতে পারে।
১৯৯৫ সালে বিরোধী দলসমূহের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিয়ে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছিলেন খালেদা জিয়া। তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে এই ধরণের রাজনৈতিক মহানুভতার উদাহরণ বিরল। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় যাবার পর আওয়ামীলীগ বিএনপিসহ সকল প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করেছে। এখন দলটি পয়েন্ট অব নো রিটার্ন- এ পৌঁছে গেছে বলে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পর্যুদস্ত করে ফেলেছে। এর সমাধান মাঝখান থেকে চাইলে পাওয়া যাবে না। কমিশনে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে সকল পক্ষের মনে এই বিশ্বাসের জন্ম দেওয়া জরুরি যে বিরোধী দলে থাকলে তারা হামলা বা নির্যাতনের শিকার হবে না।
বিএনপি দেশের প্রথম বা দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। এর সদস্যদের আবেগ, আনুগত্য ও ভালবাসার কেন্দ্রবিন্দু জিয়াউর রহমান। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের ১৭ জন সেক্টর কমান্ডারের একজন। তিনি জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন, ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, কামালপুরের যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সিলেট দখল করার সময় জেনারেল কে.ভি. কৃষ্ণরাওয়ের বাহিনীর পাশাপাশি তার বাহিনী বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ করেছে এবং সর্বোপরি যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি বীর উত্তম খেতাব পেয়েছেন। তিনি শাসক ছিলেন, কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবর্তক যা এদেশে খুবই জনপ্রিয় একটা রাজনৈতিক দর্শনের ধারা। জিয়া বা তার মত বীর যোদ্ধাদের অবদানকে অস্বীকার করলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কলুষিত হয় এবং নিচুতা প্রকাশ পায়। বিস্তর সুযোগ থাকা সত্বেও জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেননি। তার নির্দেশে হাসান হাফিজুর রহমান ১৫ খন্ডে যে স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র সংকলন করেছেন সেটা ছিল বিস্ময়কররকম পক্ষপাতহীন।
পক্ষান্তরে আওয়ামীলীগ নেতারা তাকে পাকিস্তানের চর বলে কুৎসা রটানোর চেষ্টা করেছেন, তাকে ‘মেজর রিট্রিট’ বলে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। এমনকি সংসদেও তাকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদের সমালোচনা করায় মহান মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীকে রাজাকার বলা হয়েছে। প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী আ.স.ম. আব্দুর রবকে স্বাধীনতার অনুষ্ঠানে ডাকা হয় না। কনভেনশনের দ্বিতীয় ধাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন; যুক্ত হতে পারে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট ও ভোটের সংখ্যানুপাত ভিত্তিক আসন বণ্টন। শুরুতেই বলেছি রূপরেখাটি সুচিন্তিত ও সুলিখিত। এতে সমস্যার প্রায় সকল ক্ষেত্র চিহ্নিত করে সমাধানের পথ বলা হয়েছে। সরকার সহ সকল পক্ষের উচিত বিএনপির এই চমৎকার উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে সেটাকে বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে নেওয়া।