বুধবার, ০৫ অক্টোবর, ২০২২
মো: ওবায়েদ উল্যাহ ভূলন: সু-শাসন হচ্ছে এক ধরণের শাসন প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ক্ষমতা সুষ্ঠুভাবে চর্চা করা হয়। এই শাসন প্রক্রিয়ায় জনগণ স্বাধীনভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে, সরকারের নীতি ও কর্মকান্ড সম্পর্কে অবগত থাকে এবং নারী -পুরুষ স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করতে পারে।
বাংলাদেশে সুশাসনের ক্ষেত্রে সমস্যা অনেক। বেশ কিছু আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-প্রশাসনিক সমস্যা সুশাসনের পথে বিরাট বাধা হিসেবে কাজ করছে।
রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতার অভাব: বাংলাদেশের সুশাসনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ জবাবদিহিতার অভাব। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার অভাবের জন্য কিছু বিষয় কাজ করে। এগুলো হল: প্রশাসনিক জটিলতা, দুর্বল সংসদ, অনুন্নত রাজনৈতিক দল, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব এবং দুর্বল নির্বাচন ব্যবস্থা। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি সংসদে কোন শক্তিশালী বিরোধীদল ছিল না। এ কারণে সংসদ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারছে না। আমলারা অনেক সময় জনগণের সামনে সঠিক ও সত্য তথ্য প্রচার করতে চায় না। শাসক শ্রেণীরও একটি অংশ তথ্য গোপনের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে চায়। এই অস¦চ্ছতা দুর্নীতির জন্ম দেয় এবং সুশাসনের অন্তরায় হিসেবে কাজ করে।
অংশগ্রহণের অভাব: বাংলাদেশের সুশাসনের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের অভাব। জনগণের অংশগ্রহণ না থাকলে কখনোই যোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত করা যায় না। জনগণের মতামত বা অংশগ্রহণ ভোটদানের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা কোন সমস্যা সমাধানে জনগণের মতামত নেওয়া হয় না। এক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ একেবারেই কম।
আইনের শাসনের অভাব: সুশাসনের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আইনের শাসনের অভাব। বাংলাদেশে আইনের শাসনের অভাব তো রয়েছেই; তাছাড়া এখানে যে আইনগুলো বিদ্যমান রয়েছে সেগুলোর সঠিক চর্চা করা হয় না।
বিকেন্দ্রীকরণের অভাব: সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের জন্য বিকেন্দ্রীকরণ একটি অপরিহার্য শর্ত। বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারকে প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বাংলাদেশে সুশাসনের ক্ষেত্রে সমস্যা অনেক বেশি। বেশ কিছু আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-প্রশাসনিক সমস্যা সুশাসনের পথে বিরাট বাধা হিসেবে কাজ করছে।
দুর্নীতি: বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশে সুশাসনের ক্ষেত্রে দুর্নীতি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দুর্নীতির কারণে গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সুশাসনের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়েছে। জনগণের সরকারি সুযোগ-সুবিধা কমে যাচ্ছে। ক্ষমতাবান কিছু ব্যক্তি ফায়দা লুটছে।
শিক্ষা, স্বাস্থ্যখাত, ভূমি প্রশাসন, জন প্রশাসন, ব্যাংকিং, বিদ্যুৎ সেক্টর, স্থানীয় সরকার- এক কথায় বাজার ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, সকল ক্ষেত্রেই দুর্নীতির সংস্কৃতি লক্ষণীয়।
মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ক্ষমতার অপব্যবহার: দেশে ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। শিশু ও নারী নির্যাতন, নারীর অধিকার লঙ্ঘন, শিশুশ্রম এবং নাগরিকের স্বাধীনতাহরণ মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুস্পষ্ট উদাহরণ। প্রত্যেক সরকারই সন্ত্রাসীদের বিচারের পরিবর্তে ক্রস-ফায়ারের মাধ্যমে মেরে ফেলছে। তাছাড়া গুম, অপহরণ বাংলাদেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আরেকটি বাধা।
আমলাতান্ত্রিকতা ও দুর্বল সুশীল সমাজ: রাজনৈতিক দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশে আমলাদের কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁরা নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী ক্ষমতা ও নীতিমালা প্রয়োগ করছে। দেশের সুশীল সমাজ অত্যন্ত দুর্বল। তারা অনেক বিষয়ে রাজনৈতিক মতামত ব্যক্ত করে সরকারের বিভিন্ন অন্যায় কার্যক্রমের সমালোচনা না করে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের সুশীল সমাজ কার্যত সরকার ও বিরোধী দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ফলত সুশীল সমাজ কাক্সিক্ষত ভূমিকা পালন করতে পারছে না।
দারিদ্র্য ও নিম্নমানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি: আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী এ সকল লোক বিভিন্ন অন্যায় কাজে জড়িয়ে পড়ে। এটি সুশাসনের জন্য একটি বড় বাঁধা। উপরন্তু তাদের খাদ্য, স্বাস্থ্য,শিক্ষা, বাসস্থানসহ মৌলিক অধিকার রক্ষা করা সরকারের জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে দারিদ্র্য নি¤œমানের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব: সুশাসনের জন্য বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে পৃথক করা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ পুরো কার্যকর হয়নি। উচ্চ আদালত স্বাধীনতা ভোগ করলেও নিন্ম আদালত কার্যত শাসন বিভাগের অধীন।
পরিশেষে বলা যায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা সকলের কাম্য, কিন্তু এটি প্রতিষ্ঠা করা সহজ নয়। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের সদিচ্ছার পাশাপাশি জনগণের সমর্থন ও সহযোগিতা একান্ত জরুরি।যে শাসন ব্যবস্থায় আইনের শাসন, দায়িত্বশীলতা, জবাবদিহিতা, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ এবং জনগণের অংশগ্রহণ গনতান্ত্রিক উপায়ে সুনিশ্চিত হয় তাকেই সুশাসন বলে। কিছু সরকারি অফিস ডিজিটাইজ করা হলেও এখনো ঘুস-দুর্নীতির প্রবণতা রয়ে গেছে।
বস্তুত দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দেশে সহজে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে বড় বাধা এখনো। তাছাড়া কর দেওয়ার ক্ষেত্রে হয়রানি, জমির নামজারি করতে মাত্রাতিরিক্ত টাকা-এসবও উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করে। দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরেই ভালো নয়। করোনার কারণে তা আরও খারাপ হয়েছে। আমরা জানি, বিদেশিরা অনেক কিছু দেখে বিনিয়োগ করে। এর অন্যতম হলো বিশ্বব্যাংকের ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ রিপোর্ট। অথচ ডুয়িং বিজনেসের বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো নয়। নানা ধরনের প্রক্রিয়াগত ও আইনি জটিলতার কারণে শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কখনো বা প্রলম্বিত হচ্ছে প্রক্রিয়া। এ কারণে নতুন শিল্পদ্যোক্তারা বিনিয়োগে উৎসাহবোধ করেন না। শিল্পায়নের স্বার্থে সরকারের উচিত অবিলম্বে এসব দিকে দৃষ্টি দেওয়া। উদ্যোক্তারা মনে করেন, ব্যবসা সহজীকরণে অ্যানালগ প্রক্রিয়া ডিজিটাল করে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হবে না, পুরো প্রক্রিয়াকেই ঢেলে সাজাতে হবে।
দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়লে, শিল্পায়ন ঘটলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। দৃঢ় হবে দেশের অর্থনীতির ভিত। ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নত হলে উন্নয়নশীল এবং পরবর্তী ধাপে উন্নত দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার পথটিও মসৃণ হবে, সন্দেহ নেই। আশা করব, এ ক্ষেত্রে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করা হবে।
সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, সু-শাসন হল প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ যার মাধ্যমে নাগরিক নিজের সাথে এবং সরকারি কর্মকর্তা বা এজেন্সির সাথে একত্রে কাজ করতে পারে, যাতে নাগরিকদের আতœ-মর্যাদা উপলব্ধিতে সমর্থন যোগায় ও আর্থ-সামাজিক রূপান্তরে সহায়তা করে। রাষ্ট্রীয় শাসন কাঠামোকে জনগণের কল্যাণে কাজে লাগাবার জন্য নব্বই দশকে শাসন ব্যবস্থায় একটি নতুন ধারণার অবতারণা হয়েছে। আর এই ধারণাটি হল নানা ধরণের এজেন্সি ও দাতাসংস্থা প্রদত্ত সুশাসন সম্পর্কিত ধারণা।বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে ভালো শাসনব্যবস্থা হিসিবে স্বীকৃতি পেয়েছে- গণতন্ত্র। গণতন্ত্র ছাড়া প্রতিষ্ঠা পায় না- সুশাসন। সুশাসনের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য- স্বচ্ছতা। সুশাসনের পূর্ব শর্ত হল- জবাবদিহিতা। সুশাসনের মানদণ্ড-জনগণের সম্মতি ও সন্তুষ্টি।যেখানে দেশপ্রেম নেই সেখানে- সুশাসন নেই। সম্পদের সুষম বন্টন করা যায়- সুশাসনের মাধ্যামে। আইন নিষ্প্রয়োজন হয়-শাসক যদি ন্যায়পরায়ণ হয়। সুশাসন একটি চলমান- ক্রিয়াশীল অবস্থা। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অপরিহার্য বিষয়-গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। সংবাদ মাধ্যমকে বলা হয়-ছায়া সরকার। প্রশাসন যন্ত্রের ধারক ও বাহক-সরকার। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে অচল হয়ে পড়ে-গণতন্ত্র। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় মূখ্য উপাদান-আইনের শাসন।শাসক যদি ন্যায়বান হয় তাহলে আইন অনাবশ্যক। আর শাসক যদি দুর্নীতিপরায়ণ হন তাহলে আইন নিরর্থক।