মো: ওবায়েদ উল্যাহ ভূলন: রাজধানীর ব্যস্ততম আদালতপাড়া থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় কূলকিনারা হয়নি। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় কার গাফিলতি ছিল তা খতিয়ে দেখছে পুলিশের পৃথক দুটি কমিটি।
কাশিমপুর কারাগার-২ কর্তৃপক্ষ ও প্রসিকিউশন বিভাগের দায়সারাগোছের তৎপরতার সুযোগে পরিকল্পনা ও রেকি করে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে- এ বিষয়ে পুলিশ নিশ্চিত হলেও এর দায় কার- সে প্রশ্নের সদুত্তর কে দেবে? দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে পাঁচ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
তবে দায় শুধু কি তাদেরই? কাউন্টার টেররিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট প্রধান মো. আসাদুজ্জামান কাশিমপুর কারাগারে যান।
সেখানে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে গাফিলতির দায় কার ছিল- এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজেছেন। জঙ্গি ছিনতাইয়ের নেতৃত্বদানকারী ও সহযোগীদের নাম পেয়েছেন তিনি।
জঙ্গিরা কোন পথে কীভাবে সটকে পড়েছে এ প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট জবাব না মিললেও রায়সাহেব বাজার থেকে যাত্রাবাড়ী রুট ধরে তারা আখাউড়া সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছেছে- এমন ধারণা করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা।
ছিনতাইয়ের ঘটনা জানাজানি, রেড এলার্ট জারি ও চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি শুরুতে যে সময় পেরিয়ে গেছে, তার মধ্যেকি জঙ্গিরা সটকে পড়তে পারে না?
হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর নিরাপত্তা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানে জঙ্গি তৎপরতা স্তিমিত হয়ে এলেও জাতীয় নির্বাচনের আগে তাদের মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টার কথা মাথায় রেখে পুলিশকে আরও সতর্ক হতে হত।
২০১৪ সালে ময়মনসিংহ থেকে আনার পথে ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে জঙ্গিরা তাদের তিন নেতাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। সালাউদ্দিন সালেহীন, জাহিদুল ইসলাম (বোমারু মিজান) ও রাকিবুল হাসান নামে ওই তিনজন ছিলেন জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা।
তাদের তিনজনের মধ্যে পরে রাকিবুল কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান, বোমারু মিজান সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার পর ভারতে ধরা পড়েন। সালেহীন এখনও অধরা।
ওই তিনজন জেএমবির নেতা হলেও এবার যারা পালিয়েছেন, সেই মইনুল হাসান শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান এবং আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব আরেক সংগঠন আনসার আল ইসলামের নেতা। এই দলের শীর্ষ নেতা সেনাবাহিনীর বরখাস্ত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক দীর্ঘদিন ধরে পালিয়ে আছেন।
মইনুল ও সোহেল দুজনই প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যামামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। সোহেল লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলাতেও মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত।
হেলমেট ছাড়া বাইক চালালে বা লেন ভঙ্গ করলে দশ হাজার টাকা জরিমানার ব্যবস্থা রেখে দেশে কার্যকর আলোচিত সড়ক পরিহন আইন-২০১৮। দুই জনের বেশি বাইকে চলাচল নিষেধ। আইন ও কার্যক্রম চলমান থাকাবস্থার মধ্যেই জঙ্গিরা এক বাইকে হেলমেট ছাড়াই তিন জনকে বহন করে নিরাপদে সটকে পড়া জঙ্গি ছিনতাইয়ের এই ঘটনায় পুলিশের অবহেলা ও অপেশাদারিত্ব দুটোই ষ্পষ্ট। যাদের কারণে এমন অবহেলা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই হবে।
জঙ্গি ছিনতাইয়ে প্রথমত, এক ধরনের গাফলাতি হয়েছে পুলিশের। সেখানে জেল পুলিশ বা আদালত পুলিশ, যার দায়িত্বেই থাকুক, এটা বড় ধরনের অবহেলা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এদের যে নেটওয়ার্ক রয়েছে তাদেরকেও আইডেন্টিফিকেশন করা খুবই প্রয়োজন।
জঙ্গি দলগুলোর ভেতরে যারা এ ধরনের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে রয়েছে, তাদের জন্য সব সময়ই এক ধরনের এক্সট্রা অর্ডিনারি সার্ভিলেন্স থাকা উচিৎ পুলিশের।
ইদানিং আবার জঙ্গি সংগঠনের মাথাচাড়া দেওয়ার ইঙ্গিত মিলছিল, আবার সামনের বছর নির্বাচন রয়েছে, এসব মিলিয়ে পুলিশের যতটুকু সজাগ থাকার দরকার ছিল, সেখানে ঘাটতি ছিল। গোয়েন্দা তথ্যে ঘাটতি
জঙ্গিদের পালানোর এই ঘটনায় গোয়েন্দা তথ্যের ঘাটতি ছিল।পুলিশকে আরও প্রো-অ্যাকটিভ হতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আরও তৎপর হতে হবে। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বিশেষ টিম করতে হবে। এটা রুটিন কাজে নিয়ে গেলে বা গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে দিলে হবে না।
জঙ্গিবাদ নির্মূলের আত্মপ্রসাদে ভোগার কিছু নেই। জঙ্গিদের অনুসারী রয়েছে। তাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব রয়েছে। ওরা একেবারে বিলীন হয়ে যায়নি।
এখন জঙ্গিরা তো মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে। কোর্টের হাজার মানুষের সামনে থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তারা জানান দিচ্ছে যে তারা আছে।
যেহেতু অনলাইনে তাদের রিক্রুটমেন্ট চলছে, আমরা দেখছি- গত জুলাই অগাস্ট থেকে অনেক তরুণ নিঁখোঁজ হয়েছে। একই সঙ্গে সামনে নির্বাচনের সময়ও আসছে। সবকিছু মিলিয়ে আমার মনে হচ্ছে-বাংলাদেশের এ সময়টি ও এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে কিছুটা হলে দেশের পরিস্থিতি, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নষ্ট করার জন্যে এক ধরনের ষড়যন্ত্র। যখন তারা পালাচ্ছে, এরকম না যে তারা নিজে পালিয়ে হারিয়ে গেল।
জঙ্গি ছিনতাইয়ের দায় কোনোভাবেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এড়াতে পারে না। নিরাপত্তার ঘাটতি কোথায় কোথায় ছিল তা বের করে কার গাফিলতি ছিল তাও খুঁজে বের করতে হবে। গাফিলতি দূর করে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়া গেলে ভবিষ্যতে আরো বড় ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। এতে নাগরিক, সমাজ ও রাষ্ট্র হুমকির মুখে পড়বে।
আদালতপাড়া বরাবরই অরক্ষিত। এখানে ভরদুপুরে খুন হয়েছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী মুরগি মিলন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে ঢাকার কোর্টহাজত থেকে পিস্তলের গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে যায় গামা, মকুট, কিবলু ও হোসেন নামে ৪ আসামি। পিস্তলটি বিরিয়ানির প্যাকেটে ভরে হাজতে নেয়া হয়েছিল। আশির দশকে আদালতপাড়া থেকে গুলি ছুড়ে ও বোমা ফাটিয়ে পালিয়ে যায় দুর্ধর্ষ ডাকাত মকিম গাজি। প্রতিদিন ঢাকা ও কাশিমপুর কারাগার থেকে কয়েকশ আসামি এই আদালতে আনা-নেয়া করা হলেও নিরাপত্তা ব্যবস্থা বরাবরই ঢিলেঢালা।
কারা অধিদপ্তরের ডিআইজি তৌহিদুল ইসলাম ডাণ্ডাবেড়ি না পরানো এবং গাফিলতি নিয়ে কথা না বলে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো পরিসংখ্যানে জানিয়েছেন, কারাগারের মোট ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার ৬২৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৪০ হাজার ৬৯৭ জন ও মহিলা ১ হাজার ৯২৯ জন। মোট আটক বন্দি : ৮৪ হাজার ১১৫ জন। এতে পুরুষ ৮০ হাজার ৭৭৬ জন ও মহিলা ৩ হাজার ৩৩৯ জন।
জঙ্গি সম্পৃক্ত আসামিদের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঢিলেঢালা ভাব দেখানোয় প্রশ্ন উঠেছে আদালতের বিচারক, আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তা নিয়েও। জঙ্গিরা আরও সশস্ত্রভাবে বড় ধরনের হামলা করলে বড় হতাহতের ঘটনাও ঘটতে পারতো ।দুর্ধর্ষ আসামির ক্ষেত্রে ডাণ্ডাবেড়ি পরানোর নিয়ম থাকলেও আসামিদের হ্যান্ডকাফ পরানো ছিল ডাণ্ডাবেড়ি পরানো হয়নি। নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা ছিল তারাই ভালো বলতে পারবেন কেন ডাণ্ডাবেড়ি পরানো হয়নি।খোদ ঢাকার আদালত চত্বর থেকে এভাবে পুলিশের ওপর হামলা করে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা সত্যি উদ্বেগজনক।