শনিবার, ০৭ জুন, ২০২৫
মো: ওবায়েদ উল্যাহ ভূলন: রুচি নিয়ে বিস্তর কথা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রীতিমতো ‘ভার্চুয়াল’ বন্যা বয়ে যাচ্ছে এর পক্ষে-বিপক্ষে।
রুচি নিয়ে বেদনার বিষয় হলো, এ বিতর্কে শামিল হয়ে আমরা নিজেরাও সুরুচির পরিচয় দিচ্ছি কি? রুচি কী? রুচি কীভাবে নির্মিত হয়? রুচিকে শক্তভিত্তির ওপর দাঁড় করায় কোন সে প্রপঞ্চ? রুচির সঙ্গে দুর্ভিক্ষের সম্পর্ক সুনিবিড় বলেই আমাদের যাপিত জীবনের সঙ্গে ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ কথাটি না চাইলেও জড়িয়ে যায়। আর বাস্তবতা হলো, আমরা রুচির পরিচয় দিতে ব্যর্থ হচ্ছি। সেক্ষেত্রে ‘সুরুচি’ তো রীতিমতো কল্পনাবিলাস—অন্ধের হাতি দেখার শামিল।
দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গ দিয়েই আলাপ এগিয়ে নেয়া যাক। এই ভূগোলের মানুষের দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা দুটো। যা হয়েছিল অবিভক্ত ভারতবর্ষে, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায়। প্রথমটা ইংরেজ উপনিবেশের একেবারে শুরুর দিকে, দ্বিতীয়টা তাদের বিদায়ের একেবারে শেষাংশে। দুটো দুর্ভিক্ষকেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে ‘ভিন্ন রঙ’ লাগানোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের সত্য হচ্ছে, এর জন্য দায়ী ব্রিটিশ শাসনের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অদক্ষতা, প্রশাসনিক অযোগ্যতা এবং শোষণমূলক নীতিগুলো।
প্রথম দুর্ভিক্ষ ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ হিসেবে সব মহলে পরিচিত। ওই দুর্ভিক্ষে অবিভক্ত বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এর আগে বাংলায় কখনো এ রকম তো নয়ই, কোনো দুর্ভিক্ষই দেখা দেয়নি। তখনো বাংলার শাসনক্ষমতা ব্রিটেনের সরকারের হাতে যায়নি, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন চলছে। সে সময় শুধু প্রশাসনিক শাসন ও শোষণের কারণে বাংলাজুড়ে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়।
ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার শাসনক্ষমতার একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে বাংলায় আবার দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এ সময়ও শাসকদের চিরচেনা চেহারা প্রকাশ পায়। তারা প্রাকৃতিক দুর্যোগকে দুর্ভিক্ষের কারণ বলে চিহ্নিত করে। যখন কলকাতার রাস্তার অলি-গলিতে ভুখানাঙ্গা মানুষ একটু ভাতের ফেনের আশায় আহাজারি করে ফিরছে, ময়লা ফেলার ঝুড়ির মধ্যে মানুষ-কুকুর-শেয়াল-শকুন-কাক সামান্য খাবার খুঁজে পেতে প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছে। তখনো সরকারি গুদামগুলোয় খাদ্যশস্যের পর্যাপ্ত মজুদ ছিল। সেগুলো জমিয়ে রাখা হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ব্রিটিশ সৈনিকদের ভবিষ্যৎ খাবারের যেন সংকট দেখা না দেয়। শুধু উইনস্টন চার্চিলের ভুল নীতির কারণে অবিভক্ত বাংলায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয়।
চার্চিলকে বলা হয় সর্বকালের সেরা ব্রিটিশ, তিনি নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন। ব্রিটিশদের কাছে যিনি নায়ক হিসেবে বিবেচিত, বাংলার মানুষের কাছে আজও তিনি খলনায়ক হিসেবে পরিচিত। তিতাল্লিশের মন্বন্তরের ভয়াবহ দৃশ্য ধরা পড়েছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের রঙ-তুলিতেও।
আজ থেকে দুই বছর আগে, ২০২৩ সালে নাট্যজন মামুনুর রশীদ ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ চলছে বলে মন্তব্য করেন। সেই কথাটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। নানাজন নানাভাবে এটাকে ব্যাখ্যা করেন। অনেকে তাকে কটাক্ষ করেন। অনেকে তাকে হেয় করার চেষ্টা করেন। পরে মামুুনুর রশীদ ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’র ব্যাখ্যা দেন। তিনি মূলত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের কিছু নিম্নমানের ‘ডায়ালগ ও দৃশ্য’কে বোঝান। এখন সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছি না। ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ কাটিয়ে উঠতে সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশের আহ্বান জানান তিনি। পরে তার সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে অনেক সংগঠন ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। দুই বছর পর এসে আজ মনে হচ্ছে মামুনুর রশীদ যথার্থই বলেছিলেন। সত্যিকার অর্থেই দেশে এখন রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে। সাংস্কৃতিক অঙ্গন ছাপিয়ে এই দুর্ভিক্ষ খোদ রাজনীতিতেও চলছে। যদি দুর্ভিক্ষই না হয়, তাহলে মেয়েরা কীভাবে নিজেদের ‘বেশ্যা’ বলে স্লোগান দিতে পারেন! বিষয়টি ভাবলেই গা শিউরে উঠে। আহ! আমরা নিচে নামতে নামতে আর জায়গা রাখছি না!
গত ১৬ মে বিকেলে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ‘নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা’র ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। ঘোষণাপত্র পাঠ শেষে বিকেল সোয়া ৫টা নাগাদ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা ‘ন্যায্যতাই সমতা, সমতাই ন্যায্যতা’, ‘পাহাড় থেকে সমতলে, লড়াই হবে সমানতালে’, ‘ঘরে-বাইরে-প্রতিষ্ঠানে, ব্যাটাগিরি চলবে না’, ‘চেয়েছিলাম হিস্যা, হয়ে গেলাম বেশ্যা’ ইত্যাদি স্লোগান দেন। এ সংক্রান্ত হাজারো ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেক নেটিজেন নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। বিষ্ময় প্রকাশও করেছেন অনেকে। সমালোচনা ও প্রশ্নও রেখেছেন কেউ কেউ। কিন্তু কেউ তাদের ‘চেয়েছিলাম হিস্যা, হয়ে গেলাম বেশ্যা’ স্লোগানের পক্ষে লেখেননি। এমনকি আমার জানামতে কোনও নারী এই স্লোগানের পক্ষাবলম্বন করেননি। বিষয়টি যে দৃষ্টিকটূ হয়েছে, সেটাই তারা বলছেন।
কিন্তু মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা ‘চেয়েছিলাম হিস্যা, হয়ে গেলাম বেশ্যা’ স্লোগান কেন দিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। মিছিলকারীরা গত বছর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনের সঙ্গে মিশিয়ে এই স্লোগান তৈরি করেছেন। তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতিরা (সরকারি চাকরিতে কোটা) পাবে না তো, রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে? তার এই কথায় ক্ষোভে ফেঁটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষাঙ্গন বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দেন ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার, কে বলেছে, স্বৈরাচার।’ সেই স্লোগানের সঙ্গে মিল রেখেই হয়তো আজকের ‘চেয়েছিলাম হিস্যা, হয়ে গেলাম বেশ্যা’ স্লোগান তৈরি করা হয়েছে। তাদের এই স্লোগান কিন্তু ক্ষোভের প্রকাশ। তারা শখ করে কিংবা বাহাদুরি দেখাতে এই স্লোগান দেননি। তাদের বেশ্যা বলা হয়েছে এবং সেই ক্ষোভ থেকে তারা এই স্লোগান দিয়েছেন। ক্ষোভ থেকে হলেও এই স্লোগান তাদের দেওয়া ঠিক হয়নি বলেই মনে হয়। এটা তাদের মহিমান্বিত করেছে, নাকি তুচ্ছ করেছে? কিন্তু তারা এই স্লোগান কেন দিলেন? তারা অন্তর্বর্তী সরকার এবং হেফাজতে ইসলামের ওপর ক্ষোভ থেকেই এই স্লোগান দিয়েছেন বিষয়টি উঠে এসেছে তাদের কথাতেই। তাদের ভাষ্য, জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে নারীসহ অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অগ্রযাত্রায় নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা।
নারীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রেও তারা বাধা তৈরি করছে। জুলাইয়ে অসংখ্য নারীর আত্মত্যাগ ও শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার নারীর ওপর অব্যাহত নিপীড়ন, অবমাননা ও অপমানের বিরুদ্ধে আশ্চর্য রকম নিশ্চুপ। সরকারের নিজের তৈরি করা নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্যদের ওপর ন্যক্কারজনক আক্রমণের পরেও সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কর্মসূচি থেকে নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা নিশ্চিত এবং গুজব ও ধর্মীয় উসকানির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। ‘সমতার দাবিতে আমরা’ স্লোগানের এই কর্মসূচিতে প্রগতিশীল নারী, শ্রমিক, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মী, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন।
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে: নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে হেফাজতে ইসলাম। প্রকাশ্য সমাবেশে নারীকে ‘বেশ্যা’ বলে গালি দেওয়ার অভিযোগ উঠে তাদের বিরুদ্ধে। জনসম্মুখে নারীদের ‘বেশ্যা’ বলার অভিযোগে হেফাজতে ইসলামকে আইনি নোটিশ দিয়েছিলেন ছয় নারী। তাদের তিনজন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেত্রী এবং বাকিরা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজন। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে রয়েছেন উম্মে রায়হানা, উম্মে ফারহানা ও ক্যামেলিয়া শারমিন চূড়া। এনসিপির তিন নারী নেত্রী হলেন সৈয়দা নীলিমা দোলা, দ্যুতি অরণ্য চৌধুরী ও নীলা আফরোজ। ৫ মে সৈয়দা নীলিমা দোলা ও দ্যুতি অরণ্য চৌধুরীর সই করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নারীদের প্রতি হেফাজতের প্রকাশ্য বিদ্বেষমূলক মন্তব্য, বিশেষ করে মাইকে নারীকে ‘বেশ্যা’ বলে গালি দেওয়া, কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। পাবলিক স্পেসে নারীকে গালি দেওয়ার অধিকার কারো নেই। নতুন বাংলাদেশে এ ধরনের নিপীড়নের কোনো স্থান নেই। প্রস্তাবিত নারী সংস্কার কমিশন নিয়ে মতবিরোধ থাকতে পারে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে নারীদের প্রতি অবমাননাকর ভাষা ব্যবহার করা যাবে, মন্তব্যও করেন নোটিশদাতারা। পরে ওই ঘটনায় হেফাজতে ইসলাম দুঃখ প্রকাশ করে এবং বিষয়টিকে সাধুবাদ জানান ওই ছয় নারী। হেফাজতের দুঃখ প্রকাশের পর দেওয়া বিবৃতিতে তারা বলেন, নারীকে পাবলিক স্পেসে গালি দেওয়ার পর তাদের ক্ষমা চাওয়াকে আমরা সাধুবাদ জানাই এবং গ্রহণ করি। তবে আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করেছি তারা প্রেস রিলিজে বলেছেন, ‘নারীকে পণ্য’ বানানোর পশ্চিমা এজেন্ডা তারা মেনে নেবেন না এবং ধর্মীয় ইস্যুতে বাড়াবাড়ি করলে ছাড় দেবেন না। উগ্র নারীবাদীদের লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফ্রেমিংয়ের রাজনীতি থেকে তাদের (হেফাজত) আমরা বেরিয়ে আসার আহ্বান জানাই। কারো মতের সঙ্গে না মিললেই তাকে কোনো না কোনো ট্যাগ দেওয়া যাবে না।
নারী নেত্রীদের বক্তব্য খুবই সুন্দর। তাদের সঙ্গে আমি একটু দ্বিমত পোষণ করতে চাই। শুধু পাবলিক প্লেস নয়, কোথাও নারীকে গালি দেওয়া যাবে না। ইসলাম ধর্মে নারীর মর্যাদা অনেক। তাকে গালি দেওয়ার অধিকার কারো নেই। কিন্তু হেফাজতে ইসলাম বিষয়টি নিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলো; আপনারা ক্ষমা করে দিলেন এবং ভুল বুঝতে পারায় তাদের সাধুবাদ জানালেন। এরপরও কেন বিষয়টি নিয়ে স্লোগান দিলেন? মীমাংসিত বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি না করলে কী হতো না?
আলেমদের ভূমিকা: বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। ২০২২ সালের আদমশুমারি অনুসারে এদেশে মুসলমান জনগোষ্ঠী ৯১.০৪ শতাংশ। এ দেশে আলেমদের গুরুত্ব অনেক বেশি। তারা ধর্মীয় নেতা। মানুষ তাদের সম্মান করে, অনুসরণ করে। তাদের কথা বলতে হবে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। তাদের এমন কোনও কথা বলা উচিত নয়, যা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। বিদ্বেষ সৃষ্টি হতে পারে এমন কর্মকাণ্ড পরিহার করাই শ্রেয়। মনে রাখতে হবে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখাও আলেমদের কাজেরই অংশ।