খোকন হাওলাদার, সাভার (ঢাকা) প্রতিনিধি: মৌসুমের শুরুতে গোলাপের ফলন ভালো হলেও শেষটা ভালো যাচ্ছে না কৃষকের। অজানা ছত্রাকের হানায় নষ্ট হচ্ছে ফুলের রানী গোলাপ।
ফলে চহিদার তুলনায় উৎপাদন কম থাকায় ভালোবাসা দিবসের ফুলের বাজার এখন বেশ চড়া। উৎপাদন কম হওয়ায় ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে গোলাপের দাম বেড়েছে তিনগুণ।
সোমবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) সাভারের বিরুলিয়ার বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে সাভারের গোলাপ গ্রামের চাষিরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। অঞ্চলটির বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে গোলাপ বাগান। সাদা ক্যাপ মোড়ানো গোলাপের কুঁড়ি বাতাসে দুলছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর গোলাপের উৎপাদন বেশি হয়েছে। তবে ছত্রাকের কারণে অধিকাংশ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত। গাছের পাতা, ডাল কিংবা কুঁড়ি পচে ঝরে যাচ্ছে। কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক স্প্রে করেও মিলছে না সমাধান।
অনেক গাছের শাখা-প্রশাখা লালচে হয়ে আবার কালো হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও গাছের পুরো অংশই কালো হয়ে গেছে। কলি আসলেও ফুল না ফুটেই ঝরে যাচ্ছে। ফলনের ক্ষতি ঠেকাতে নানা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন চাষিরা।
গোলাপচাষি আব্দুল খালেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চার বিঘা জমিতে গোলাপ চাষ করেছেন তিনি। এবছর গোলাপ গাছে পচা রোগ লেগেছে। গাছের পাতা, ডাল, কুঁড়ি পচে যাচ্ছে। বিভিন্ন রকমের ওষুধ দিয়েও আশানুরূপ কাজ হচ্ছে না।
তিনি বলেন, মৌসুমের প্রথম দিকে গোলাপের ফলন ভালোই ছিল। তবে শেষে এসে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। অজানা ছত্রাকের আক্রমণে চাষিরা শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীরা এখানে পরিদর্শন করেন। তবে তাদের কোনো পরামর্শ কাজে আসছে না। কৃষি প্রধান এই দেশে সবকিছুরই গবেষণা করা হয়। কিন্তু গোলাপের ওপর কোনো গবেষণা নেই। লাখ লাখ টাকা খরচ করে গোলাপ ফুল চাষ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করা হয়। এই শিল্প থেকে শত শত মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, গোলাপ ফুলে ছত্রাক কিংবা নানা রোগের যখন আক্রমণ ঘটে তখন এই শিল্প রক্ষায় কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাভার উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এবছর ২৩০ হেক্টর জমিতে গোলাপের চাষ হয়েছে। ১৯৯০ সালে মিরপুর থেকে এসে বিরুলিয়ায় প্রথম গোলাপের চাষ করেন সাদেকুল নামের এক ব্যক্তি। তার বাণিজ্যিকভাবে গোলাপ চাষ দেখে স্থানীয়রাও উদ্বুদ্ধ হয়ে শুরু করেন গোলাপের চাষ। চাষিরা লাভবান হওয়ায় ইউনিয়নের মোইস্তাপাড়া, সামাইর, শ্যামপুর, সাদুল্লাপুরসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে গোলাপ চাষ। এখানে মেরিন্ডা, হাজারি, লিংকন, পাপা মিলন, বধূয়া বা হলুদ ও সাদা জাতের গোলাপের চাষ হয়। তবে বাজারে চাহিদা বেশি লাল মেরিন্ডার। এ গ্রামের ৯০ শতাংশ মানুষেরই প্রধান জীবিকা ফুলচাষ।
অপর এক ফুলচাষি নাজিমুদ্দিন জানান, গত কয়েক দিন ধরেই বেচা-বিক্রি বেশি। তবে যতটুকু আমরা আশা করেছিলাম ততটুকু ফুল বিক্রি করতে পারছি না। গত কয়েক দিন আগেই প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০টি ফুল তোলা গেছে। কিন্তু বর্তমানে ৫০টিও পাওয়া যাচ্ছে না। ছত্রাকের কারণে কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটার আগেই সব পচে গেছে। এতে চাহিদা থাকলেও বিক্রি করা যাচ্ছে না।
বাগানের এ পরিস্থিতিতে বাজারে প্রভাব পড়েছে দামে। এ সময়টাতে সাধারণত ৩০০ পিসের ১ বান্ডিল গোলাপ বিক্রি হয় ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকায়। তবে ফেব্রুয়ারির শুরুতেই এর দাম হয়ে যায় ৪ হাজার টাকা। কিন্তু এবার উৎপাদন কম থাকায় ভালোবাসা দিবসকে কেন্দ্র করে ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে যার দাম হয়েছে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা অর্থাৎ প্রায় ৩ গুণ।
বিরুলিয়ার গোলাপচাষি আনোয়ার হোসেন বলেন, ১৬ ডিসেম্বর, ১ জানুয়ারি, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২১ ফেব্রুয়ারি ও ২৬ মার্চ আমাদের মূল বিক্রির সময়। এই ধাপগুলোতে আমরা বিক্রি করতে পারলে লাভের মুখ দেখতে পারি।
উপজেলা কৃষি অফিস বলছে, প্রতি হেক্টর জমিতে ৩ লাখ ৭০ হাজার থেকে ৪ লাখ পিস ফুল পাওয়া যায়। আর হেক্টরে গোলাপ গাছ থাকে ১০ লাখ থেকে ১১ লাখের কিছু বেশি। বছরের বাকি সময়টাতে ফুল উৎপাদন যেমন কমে আসে, তেমনি কমে আসে ফুলের চাহিদা ও দাম। এছাড়া সারা বছরের উৎপাদন খরচতো আছেই। তাই বলা যায় পুরো বছরের খরচ মেটাতে মৌসুম ও বিভিন্ন দিবসকে কেন্দ্র করে বাড়তি দাম নেওয়া হয়।
সাভার উপজেলা অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা মোছা. ইশরাত জাহান জানান, সাভার উপজেলায় এবার ২৩০ হেক্টর জমিতে গোলাপের চাষ হয়েছে। এ বছর প্রায় ৪০ কোটি ফুল বিক্রি হবে বলে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। চাষিরাও লাভবান হবেন।
তবে গোলাপে ছত্রাকের আক্রমণের ব্যাপারে তিনি বলেন, আমরা উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত সেখানে পরিদর্শন করছি। চাষিদের সঙ্গে উঠান বৈঠক, বাগানের পাশে, ফুল বাজারের পাশে ফেস্টুনসহ নানা সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এছাড়া ছত্রাকের আক্রমণ ঘটলে কী ওষুধ প্রয়োগ করা হবে তার ব্যবস্থাপত্রও দেওয়া হয় কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে।