মো: ওবায়েদ উল্যাহ ভূলন: বিএনপি কি একদিন মুসলিম লীগের মতো হয়ে যাবে? ধীরে ধীরে কি নিঃশেষ হয়ে যাবে ঐতিহ্যবাহী সে দলটির মতো? এক কথায় উত্তর না। কারণ, কেন্দ্র থেকে প্রান্তে, শহর থেকে গ্রামে যে পরিমাণ কর্মী-সমর্থক আছে দলটির, তাতেই সে শঙ্কা ক্ষীণ বললেই চলে।
নিজেদের ভুলের খেসারত দিতে দিতে হয়তো পরিস্থিতি জটিল থেকে আরও জটিল হতে পারে। কিন্তু কখনো মুসলিম লীগ হবে না বিএনপি। বরং আওয়ামী লীগের অতিরিক্ত নির্যাতন-নিপীড়নেই যুগ যুগ ধরে সগৌরবে টিকে থাকবে দলটি।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে আর কতদিন? দাবি আদায়ে হেন কোনো কর্মসূচি নেই, যা পালন করেনি বিএনপি। সভা-সমাবেশ থেকে শুরু করে লিফলেট বিতরণ। ধারাবাহিক মানববন্ধন থেকে শুরু করে মোমবাতি প্রজ্বালন। সবই করেছে। পদযাত্রায় মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন নেতাকর্মীরা। তাদের দাবি পথে-পথে নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে কর্মসূচির দুই-তিনদিন আগেই নির্ধারিত স্থানে হাজির হয়েছে। পাহাড় ডিঙিয়ে, নদী পেরিয়ে সফল করেছেন বিভাগীয় গণসমাবেশ। সবশেষ তারুণ্যের রোডমার্চ করে গ্রাম-গঞ্জে গিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। এভাবে ধাপে ধাপে সবাইকে উজ্জীবিত করেছেন। আন্দোলনের পারদ তুঙ্গে তুলেছেন। সরকার পতনের আলটিমেটাম দিতে ডাকা হয়েছিল ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ।
২৮ অক্টোবর যারা দিনবদলের স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন, তারা ফিরেছেন এক বুক আক্ষেপ নিয়ে। সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা কি ছিল তৃণমূলের প্রতি? কী হলে কী করতে হবে সেভাবে কি কোনো প্রস্তুতি ছিল বিএনপির? অবশ্য ২৮ অক্টোবর কিংবা এর পরের পরিস্থিতি এত জটিল হবে, এতটা হার্ডলাইনে যাবে সরকার, তা ভাবতেই পারেনি বিএনপি।
অর্থাৎ বিএনপি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেদিন বদলে যায় পরিস্থিতি। উত্থানের এ কর্মসূচিতে বাজে পতনের সুর। পরদিন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ আটক করা হয় দলের বহু নেতাকর্মীকে। এরপর নির্বাচন পর্যন্ত সময়ে রাজনৈতিক ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে যায় দলটি। বলা যায়, প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর যেন বিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত উপকূলবাসীর স্বাভাবিক জীবনে ফেরার গল্প। নির্বাচনের পর আবারও কালো পতাকা নিয়ে রাজপথে নেমেছে দলটি। তাহলে এখন কি শূন্য থেকে শুরু করতে হবে বিএনপিকে? উত্তরে বিএনপি নেতারা বলছেন, রাজনীতিতে শূন্যতা-পূর্ণতা বলতে কিছু নেই। বিএনপির ডাকে ভোট বর্জন করেছে জনগণ, আছে আরও নানা অর্জন। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে যুদ্ধ করার সামর্থ্য নেই, এমনকি নেই ইচ্ছাও। কারণ, বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক দল, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দাবি আদায় করতে চান তারা। কিন্তু এমন কর্মসূচি দিয়ে সরকার পতন হবে কিংবা মুক্তি পাবেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া-এসব কথা বিশ্বাসই করতে চান না মাঠের কর্মী-সমর্থকরা।
বরং পরিবর্তিত এ পরিস্থিতিকে নানাভাবে মূল্যায়ন করছেন তারা। কারও ভাবনায় ভোট নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক, রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় থাকবে সরকার। কারও বিশ্বাস, যে কোনো সময় বদলে যেতে পারে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আরও ঘনীভূত হতে পারে অর্থনৈতিক সংকট। এমনকি আসতে পারে বিদেশি নিষেধাজ্ঞাও। অন্যদিকে, বাস্তবতা বিবেচনায় দলের বিভিন্ন স্তরে ভীষণ দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে। আশার পরিবর্তে নিরাশা-হতাশা গ্রাস করেছে তাদের। আবার আছে বিপরীত চিত্রও। যারা চরম প্রতিকূলতা আর নানামুখী সংকটে দলের নির্দেশনা পালন করেছে, এখনো তারা প্রতিনিয়ত ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেন। প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে বুক চিতিয়ে লড়াই করার সাহস রাখেন। এরপরও বিএনপির আন্দোলন কেন আলোর মুখ দেখেনি, এ নিয়ে বিস্তারিত গবেষণার সুযোগ রয়েছে।
প্রকাশ্যে কিংবা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় সরকারি দমনপীড়ন, মামলা-হামলা, আর নানামুখী নির্যাতন-নিপীড়নকে আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার জন্য দায়ী করে বিএনপি। প্রশ্ন তোলে, পৃথিবীর কোনো দেশে কি বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নামে এত মামলা আছে? গুম-খুনের এত এত অভিযোগ আছে সরকারের বিরুদ্ধে? রাজনৈতিকভাবে কোন দেশে এভাবে ব্যবহার করা হয় রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে? তাছাড়া এক যুগের বেশি সময় গুম-খুনের শিকার হয়েছেন অনেক নেতাকর্মী। সব মিলিয়ে ভয়ের রাজত্বে আছে সবাই। বলছেন, একটা অস্ত্রসজ্জিত রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে কতক্ষণ লড়াই করবে বিএনপির নিরস্ত্র নেতাকর্মীরা? মুহুর্মুহু গুলির মুখে কতটা কার্যকর লাঠি আর ইটপাটকেল? টিয়ারশেলের ঝাঁজালো গন্ধে, পোস্টারে আগুন দিয়ে কতক্ষণ নিশ্বাস নেওয়া সম্ভব? কিংবা বিকট শব্দের সাউন্ড গ্রেনেডের মাঝে এলেই কি উচ্চকিত হতে পারে নিপীড়িতদের স্লোগান?
কিন্তু যেসব নেতার ভার বইতে না পেরে মঞ্চ ভেঙে পড়ত কিংবা যাদের তর্জন-গর্জনে কেঁপে উঠত সরকারের মসনদ, তারা আন্দোলনের সময় কোথায় ছিলেন? কী ভূমিকা ছিল রাজপথে? নাকি সবাই আত্মগোপনে থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সমন্বয় করেছেন সবকিছু? পদধারী অনেক নেতাই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেননি। কেউ কেউ যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন তৃণমূলের সঙ্গে। আবার আত্মগোপনের সুযোগে কোনো কোনো নেতা ফোন বন্ধ রেখেছেন, কিংবা পালটে ফেলেছেন আগের নম্বর। কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে? মূল্যায়ন করছে কি বিএনপি? কোনো ব্যবস্থা কি নেওয়া হয়েছে নিষ্ক্রিয় নেতাদের বিরুদ্ধে? না নিলে নেওয়া উচিত দলের বৃহত্তর স্বার্থেই। আমি মাঠ পর্যায়ের অনেক নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের মনে অনেক প্রশ্ন আছে, পদপদবি হারানোর ভয়ে দলীয় ফোরামে সেসব তুলতে পারেন না কিংবা সুযোগ পান না। যেমন: জেলা ও থানা পর্যায়ে কি ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে নামতে পেরেছে তারা? এমন কোনো ইউনিট কি আছে যেখানে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নেই? প্রতিযোগিতা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতার সীমা লঙ্ঘন করে কি নেতারা জড়ায়নি ব্যক্তিগত বিরোধে? কোনো কোনো জেলা ও থানার সাংগঠনিক অবস্থা তো এমন যে, যতটা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কথা বলেন বিএনপি নেতারা, তার চেয়ে অনেক বলেন নিজ দলের প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে। কুৎসা রটানো হচ্ছে প্রতিনিয়ত, বন্ধ তাদের মুখ দেখাদেখিও। এছাড়া জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে রাজপথে নামাতে পারেনি বিরোধী জোট। প্রশ্ন আছে, এ দায়িত্ব শুধুই কি বিএনপির? নিশ্চয়ই না, দায় আছে আরও অনেকেরই।
আমার পর্যবেক্ষণ হলো, ২০১৪ সালে যেভাবে ভোট হয়েছে, সেভাবে হয়নি ২০১৮তে। আবার আগের দুবারের চেয়ে ২০২৪ সালে ক্ষমতাসীনদের ভোটের কৌশল ছিল আলাদা। কিন্তু এসব নির্বাচনের আগে কি ক্ষমতাসীনদের কোনো কৌশল বুঝতে পেরেছিল বিএনপি? যদি বুঝতে পারে, সেভাবে কি প্রণয়ন করা হয়েছে কর্মপরিকল্পনা, নেওয়া হয়েছিল প্রস্তুতি? আমার অন্তত মনে হয় না। তাই যা হওয়ার তাই হয়েছে, ৭ জানুয়ারি ভোট প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দলটি। নির্বাচনের কয়েকদিন পর বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদের নেতৃত্বে তালা ভেঙে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করেছেন দলীয় নেতাকর্মীরা। এরপর থেকেই প্রাণ ফিরেছে বিএনপিতে, ধীরে ধীরে আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছেন অনেকে। জামিন পাচ্ছেন দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা, কাটছে গ্রেফতার-আটকের শঙ্কাও। সব মিলিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হয়ে আসছে দলটির জন্য।
কিন্তু এখন নতুন করে কী করবে বিএনপি? আবারও সেই একই ধরনের দাবিতে সোচ্চার হবে দলটি? আবার নিশ্চয়ই সরকার পতনের ডাক দেবেন নেতারা; আবার দল গোছাতে হবে, কমিটি ভাঙা হবে, গঠন করা হবে নতুন কমিটি। কিংবা কমিটি কমিটি খেলা খেলতে খেলতেই পার হবে বছরের পর বছর? এসব প্রশ্নের উত্তরও জানেন না বিএনপির নেতাকর্মী-সমর্থকরা।
তবে একটি বিষয় তারা পরিষ্কার জানেন, বিশ্বাসও করেন। সেটি হলো, পরিস্থিতি যত জটিলই হোক, দাবি আদায় করতে হলে আবারও রাজপথেই নামতে হবে। জনগণকে আরও সম্পৃক্ত করতে হবে, বাড়াতে হবে কূটনৈতিক তৎপরতা। দলের প্রতি কমিটমেন্ট বাড়াতে হবে, কমাতে হবে আপসকামী মনোভাব। পাশাপাশি সব স্তরে নিশ্চিত করতে হবে দলীয় ঐক্য। তবেই আলোর মুখ দেখবে বিএনপির আন্দোলন।