আহমেদ আনছারি, নিজস্ব প্রতিনিধি: গত আগস্টে যখন ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশে ফেরেন তখন চারদিকে বিরাজ করছিল বিষন্ন দৃশ্যপট। রাজপথে ছিল রক্তের ছোপ ছোপ দাগ, হাজারো প্রতিবাদকারী ও শিশুর মরদেহ স্তূপ করে রাখা ছিল মর্গে, পুলিশের গুলিতে তাদের দেহ ছিল ক্ষতবিক্ষত।
১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের পর শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা।
গরীব মানুষের জন্য ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ৮৪ বছর বয়সী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে নিজের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নিয়ে চিন্তা করার আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার শাসনামলে নানা ধরনের গালমন্দ ও নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন তিনি। মুহাম্মদ ইউনূসকে হাসিনা রাজনৈতিক হুমকিও মনে করতেন। আর এ কারণে তিনি বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরে থাকতেন। তবে গণঅভ্যুত্থানের প্রতিবাদী শিক্ষার্থীরা যখন দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ জানায়, তিনি রাজি হন।
মুহাম্মদ ইউনূস যখন দায়িত্ব নিলেন সেই সময়কার পরিস্থিতির কথা তুলে ধরতে তিনি যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘শেখ হাসিনা যে ক্ষতি করেছে তা অপূরণীয়। সে সময় এটা ছিল পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটা দেশ, এটি ছিল যেন আরেকটি গাজা উপত্যকা। তবে এখানকার ভবনগুলো ধ্বংস হয়নি কিন্তু ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল সব প্রতিষ্ঠান, নীতিমালা, জনতার মনোবল এমনকি আন্তর্জাতিক সম্পর্কও।’
শেখ হাসিনার শাসনামল ছিল অত্যাচার, সংঘাত আর দুর্নীতির অভিযোগে ঠাসা। জুলাই ও আগস্ট মাসের কয়েকটি সপ্তাহ ছিল রক্তাক্ত। এ সময় ১৪০০’র বেশি লোক প্রাণ হারায় অত্যাচারী শাসনের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে, পুলিশের ভয়ানক দমনপীড়নের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান জানাতে। এই পরিস্থিতিকে জাতিসংঘ মানবতাবিরোধী অপরাধের সমতুল্য হতে পারে বলে মতামত দিয়েছে। তবে শেখ হাসিনা অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের সব অভিযোগকে অস্বীকার করেছেন।
সে সময় অধ্যাপক ইউনূসের দেশে ফিরে আসাটা যেন ছিল এক নতুন সূর্যোদয়ের মতো। দায়িত্ব নেওয়ার ছয় মাসের মধ্যে শেখ হাসিনার প্রশ্রয়ে নেই কোনো পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা, তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দায়ে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কথা বলা ও তার সমালোচনাকারীদের মুক্ত করা হয়েছে গোপন বন্দিশালা থেকে। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে মানবাধিকার কমিশন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের হয়েছে শতাধিক অভিযোগ, তবে তিনি তা অস্বীকার করেছেন।
অধ্যাপক ইউনূস প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, এই বছরের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের মার্চ মাসের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আর তা হবে কয়েক যুগের মধ্যে সবচেয়ে অবাধ ও নিরপেক্ষ। এবং এরপরই তিনি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
তবে রাজধানী ঢাকার রাস্তায় হাঁটলে মনে হবে যেন দেশ খাদের কিনারায় রয়েছে। যদিও এখনো মুহাম্মদ ইউনূসকে অনেক সম্মান করা হয়, তবে তার সরকারের সক্ষমতার বিষয়ে, তার প্রতিশ্রুত সংস্কারের বিষয়ে প্রশ্নও তোলা হচ্ছে।
রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি ক্ষমতায় যেতে মরিয়া হয়ে ওঠেছে এবং দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারে ওপর, মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। এমনকি সরকারের বৈধতা নিয়েও কথা বলছে তারা। পাশাপাশি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরাও নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছে।
পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ এখনো রয়ে গেছে। পুলিশের অনেক সদস্য ফৌজদারি অপরাধের দায়ে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার পর অনেক কর্মকর্তা তাদের দায়িত্বে ফিরতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিও হয়েছে বেশ। ঢাকার রাস্তায় সংঘবদ্ধ অপরাধের মতো ঘটনা ঘটছে, সংখ্যালঘুরা হয়রানির শিকার হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে গত সোমবার বিক্ষোভকারীরা স্বরাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টার কুশপুত্তলিকা পুড়িয়েছে তার পদত্যাগের দাবিতে।
মুহাম্মদ ইউনূস অস্বীকার করে বলেছেন যে শেখ হাসিনার সময়ের চাইতেও রাস্তাঘাট এখন অনিরাপদ এমন কথা ঠিক নয়। তবে কেউ কেউ হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তবে প্রখ্যাত ছাত্রনেতা নাহিদ ইসলাম যিনি কিনা নতুন গঠন করা জাতীয় নাগরিক পার্টির প্রধান, তিনি বলেছেন, বর্তমান অবস্থায় যে আইনশৃঙ্খরা পরিস্থিতি তাতে এই সময়ে নির্বাচন অসম্ভব হতে পারে।
এদিকে, গণঅভ্যুত্থান ও অধ্যাপক ইউনূসের ক্ষমতায় আসার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান গত সপ্তাহে বেশ শক্ত ভাষায় বলেছেন, দেশ বিশৃঙ্খল অবস্থার মুখে এবং এই বিভেদ যদি চলতে থাকে তবে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে।
মুহাম্মদ ইউনূস সামরিক বাহিনীর সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক বজায় রাখছেন। তবে কেউ কেউ সেনাপ্রধানের উক্তিকে অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে এক ধরনের হুঁশিয়ারি হিসেবে অভিহিত করেছেন।
তবে মুহাম্মদ ইউনূস সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণে দেশের এই পরিস্থিতি ও দুর্দশাকে একটি কাঠামোতে আনতে বদ্ধপরিকর। তার কথায়, শেখ হাসিনার সময়টাতে কোনো সরকার কাজ করেনি, কাজ করেছে দস্যুদের একটি পরিবার। বসের নির্দেশেই সব হতো। কেউ অসুবিধা করছে? তাকে গুম করে দেওয়া হতো। নির্বাচন করবেন? নিশ্চিত করা হতো শুধু আপনারাই সব আসন পাবেন। আপনার টাকা দরকার? লক্ষ কোটি টাকা আছে ব্যাংকে যা আপনাকে ফেরত দিতে হবে না।
শেখ হাসিনার আমলে দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের ব্যাংকিং খাত ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আর অর্থনীতি হয়ে পড়েছিল ক্ষয়িষ্ণু। আর্থিক কেলেঙ্কারির জন্য যাদের নাম এসেছে তাদের মধ্যে আছে তার ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিক যিনি যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির একজন এমপি।
তবে ইউনূস সরকারের ওপর সবচেয়ে বেশি চাপ এসেছে বাংলাদেশের বাইরে থেকে। যখন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ছিলেন তখন ভারতের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ছিল তার। এখনো তিনি ওই দেশেই পালিয়ে আছেন। এ কারণে প্রতিবেশী এই দেশটির সঙ্গে ঢাকার সম্পর্কও স্থিতিশীল নয়।
গত ডিসেম্বরে শেখ হাসিনাকে বিচারের জন্য দেশে আনতে বা প্রত্যার্পণ করতে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ অনুরোধ জানালেও ভারত সরকার তাতে কোনো সাড়া দেয়নি। তবে অদ্যাপক ইউনূসের মতে, তার অনুপস্থিতিতেও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলতে পারে।
এদিকে শুধুমাত্র ভারতের সরকার নয় হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফিরে আসাও অধ্যাপক ইউনূসের জন্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বাইডেন প্রশাসন ছিল মুহাম্মদ ইউনূসের প্রধান সমর্থক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুভাবেই। তবে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা ট্রাম্পের অগ্রাধিকারের বিষয় নাও হতে পারে।
বাংলাদেশের ওপর প্রথম আঘাতটি আসে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সহায়তা প্রদানকারী সংস্থা ইউএসএআইডির তৎপরতা বন্ধের নির্দেশনার মাধ্যমে। ট্রাম্প অভিযোগও করেন, দেশটিতে রাজনৈতিক স্থিতি বজায় রাখার জন্য তাদের কোটি কোটি ডলার খরচ হয়েছে।
অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই হুমকির পরেও তার অন্যতম সহযোগি মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্ককে মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশে স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবা প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। অনেকে বলছেন আগামী এপ্রিলে ইলন মাস্ক বাংলাদেশ সফরে আসতে পারেন।
মুহাম্মদ ইউনূস আশা প্রকাশ করেন ট্রাম্প বাংলাদেশে ভালো বিনিয়োগের সুযোগ কাজে লাগাতে পারেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক অংশীদার হতে পারে। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘ট্রাম্প একজন ডিলমেকার, তাই আমি তাকে বলেছি, আপনারা আসুন এবং আমাদের সঙ্গে ব্যবসার জন্য চুক্তি করুন। তা যদি না হয় তবে মুহাম্মদ ইউনূস কমই কষ্ট পাবেন, কেননা তিনি বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থামবে না, চলতে থাকবে।’