বাঙ্গালির সার্বজনীন উৎসব। হাজার বছর ধরে নানা ঘটনা পরিক্রমায় পহেলা বৈশাখ আজকের এই অসাম্প্রদায়িক সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। কিন্তু কিভাবে এলো এই বৈশাখ? বাংলা সনের জন্ম দিয়েছিলেন মুঘল সম্রাট আকবর, ৯৬৩ হিজরি সন হিসাব করে তার সিংহাসনে আরোহণের দিনকে নির্দিষ্ট করে। তিনি সম্ভবত বাংলা সনটি প্রণয়ন করেছিলেন রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে। কিন্তু কথা হলো, একজন মানুষ একটি সন চালু করলেন আর অমনি সেই সনটি চালু হয়ে গেল বিষয়টি তো আসলে সে রকম নয়। বঙ্গাব্দ নামে বাংলা সনটি জনপ্রিয় হতে বেশ খানিকটা সময় লেগেছিল। এর গ্রহণযোগ্যতা স্পষ্ট হতে থাকে সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়।
সে সময় নবাব মুরশিদ কুলি খাঁ খাজনা আদায়ের লক্ষ্যে ‘পুণ্যাহ’ অনুষ্ঠান প্রবর্তন করেছিলেন। সেই সঙ্গে তখনকার বণিক সম্প্রদায় তাদের বকেয়া পাওনা আদায় করার জন্য হালখাতা নামক অনুষ্ঠানের রীতিও চালু করে। তবে সাড়ম্বরে বাঙালি সমাজে পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের প্রচলন শুরু হয় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। প্রখ্যাত লেখিকা কল্যাণী দত্ত তার ‘সেকালের নববর্ষ’ লেখায় লিখেছেন— ইন্দিরা দেবীর সঙ্গে প্রমথ চৌধুরী এবং আশুতোষ চৌধুরীর সঙ্গে প্রতিভা দেবীর বিবাহের পর থেকেই নববর্ষে নতুন কাপড় পরা এবং গুরুজনদের প্রণাম করার রীতি চালু হলো। পয়লা বৈশাখ তখনকার দিনে ব্যবসায়ীদের দিন হিসেবেই গণ্য করা হতো। সন্ধেবেলা মুদি দোকান, গহনার দোকানে হালখাতার নেমন্তন্ন থাকত। বাড়ির বড়দের সঙ্গে গিয়ে মিষ্টি আর রঙিন শরবত খাওয়া চলত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বোনঝি অর্থাৎ স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা সরলা দেবী চৌধুরানীও স্মৃতিচারণা করে লিখেছেন— তখন ঠাকুরবাড়ীতে ১১ই মাঘ ছাড়া কোন উৎসব ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালে এই ঠাকুরবাড়ী থেকেই পয়লা বৈশাখ, নবান্নের উৎসবসহ নানারকম পালাপার্বণ ও বিবিধ কৃষ্টি কালচার উদ্যাপনের উৎপত্তিস্থল হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নেয়। এর পেছনে বড় একটি কারণ হলো— সে আমলে কলকাতার জোড়াসাঁকোতে ঠাকুর পরিবারটি সমাজ থেকে ছিল অনেকটা বিচ্ছিন্ন ও একঘরে। কেন? সে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। আমাদের সমাজের অনেক শিক্ষিত লোকই হয়তো জানেন না যে, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার আসলে হিন্দু ছিল না। ছিল ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী। ব্রাহ্মধর্ম একটি নতুন ধর্ম। ধর্মটির গোড়াপত্তন করেছিলেন মূলত রাজা রামমোহন রায়। সঙ্গে তার সহযোদ্ধা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, কালীনাথ রায় ও আরও অনেকে।
ব্রাহ্মধর্মের মূল ভিত্তি ছিল পৌত্তলিক বিরোধিতা ও একেশ্বরবাদে বিশ্বাস। ব্রাহ্মধর্মের অনুসারীদের মূল উদ্দেশ্য ছিল একেশ্বরবাদকে বিশ্বজনীন হিসেবে প্রচলন করা। সেদিক থেকে বিচার করলে ব্রাহ্মধর্মটি কিন্তু খ্রিস্টধর্ম ও ইসলামের অনেক কাছাকাছি। রাজা রামমোহন রায় ও প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন এ দুটি ধর্মের প্রতি প্রচ্ছন্নভাবে অনুরক্ত। বলাই বাহুল্য, এঁরা দুজনই আরবি ও ফারসি ভাষায় এতটাই পণ্ডিত ছিলেন যে, সে সময়ের আরবি ও ফারসিতে দক্ষ বহু মুসলমান মাওলানাও এদের দুজনের সমকক্ষ ছিলেন না। পাঠকদের মধ্য থেকে কেউ যদি জোড়াসাঁকোতে গিয়ে থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন যে, ঠাকুরবাড়ির প্রবেশমুখে মাঝারি গোছের একটি উপাসনালয় আছে। ব্রাহ্মধর্মের ওই উপাসনালয়টি কিন্তু দেখতে অনেকটা মসজিদের মতো। মসজিদের যেমন সামনের দিকে কেবলা মুখ করে একটি মিহরাব থাকে সে রকম আর কি। আবার সেই মিহরাবে ইমাম মিম্বারে বসে যেমন খুতবা পাঠ করেন, ঠাকুরবাড়ির সেই উপাসনালয়ে সে রকম একটি মিম্বারও আছে সিমেন্টের তৈরি।
মিম্বারের ওই বেদিতে বসেই সে সময়ে ব্রাহ্মধর্মের বইপুস্তক পাঠ করা হতো। সে যাই হোক, এ ধর্মগত কারণেই ঠাকুর পরিবারটি ছিল হিন্দু সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। একটি কথা মনে রাখা দরকার, সে সময়ের হিন্দু সমাজ ছিল অনেক গোঁড়া ও কট্টর। হিন্দুধর্মের লোকজন অন্য ধর্মের লোকদের সঙ্গে ওঠাবসা, সমাজ-আমাজ করা অনেক দূরের কথা স্বয়ং নিজ ধর্মের নিচু জাতের লোকজনের ছায়া পর্যন্ত তারা মাড়াতেন না কখনো। দৈবাৎ সে রকম কিছু ঘটলে তাদের জাত যেত। এজন্য কলকাতার সে সময়ের অন্যতম সেরা ধনী হওয়া সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারের সঙ্গে তখনকার সমাজের লোকজনের ওঠাবসা, চলনবলন হতো খুবই কম। ফলে ঠাকুরবাড়ির লোকজন নিজেদের নিয়োজিত রেখেছিলেন নানারকম সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। গানবাজনা, নাটক মঞ্চায়ন, পত্রিকা প্রকাশ, পোশাক-পরিচ্ছদ-ফ্যাশন সবকিছুতে ছিল তাদের নব নব সব উদ্যোগ। ফলে একসময় দেখা গেল ঠাকুরবাড়ির লোকজন যা-ই করছেন না কেন কলকাতার মানুষ সেগুলোই অনুসরণ ও অনুকরণ করতে থাকেন।
এই যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ সেকালের সবার মুখে লম্বা লম্বা দাড়ি রাখার প্রবণতা দেখি তাও কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম প্রচলন করেছিলেন। একবার ঠাকুরবাড়িতে যাত্রা হবে নাম- ‘নববাবুবিলাস’, সেখানে ঠাকুরবাড়ির সবাইকেই কিছু না কিছু অভিনয় করতে হবে। ঈশ্বরচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ইনি আবার মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটবেলার বন্ধু, তাকে বলা হলো দারোয়ান সাজতে হবে। তাও আবার পরচুলা-টরচুলা পরে নয়, আসল দাড়ি-গোঁফ গজিয়ে। তখন দাড়ি রাখার কোনো ফ্যাশন ছিল না। সবাই গোঁফ রাখতেন কিন্তু দাড়ি কামিয়ে ফেলতেন। ঈশ্বরবাবু বলতে শুরু করলেন— আমি তো দাড়ি গজাতে শুরু করলুম, মাঝখানে সিঁথি কেটে দাড়ি ভাগ করে গালের দুই দিক দিয়ে কানের পাশ অবধি তুলে দিই। সেই আমার দেখাদেখি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর দাড়ি রাখলেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের যেই-না দাড়ি রাখা, দেখতে দেখতে সবাই দাড়ি রাখতে শুরু করলে, আর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো সোনার চশমা ধরল। সেই থেকে দাড়ি আর সোনার চশমার একটা চল শুরু হয়ে গেল।
শেষে ছোকরারা পর্যন্ত দাড়ি আর চশমা ধরলে। এবার বুঝলে তো ভাই কোত্থেকে এই দাড়ির উৎপত্তি? এই বলে ঈশ্বরবাবু খুব গর্বের সঙ্গে বুকে হাত দিয়ে নিজেকে দেখাতেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে— পয়লা বৈশাখ নিয়ে কিছু মানুষের মধ্যে কেন সৃষ্টি হয়েছে বিভ্রান্তি। আমি মনে করি এর সঙ্গে দুটো দিক জড়িত। প্রথমত. অনেক কট্টর ও গোঁড়া মুসলমানের ধারণা পয়লা বৈশাখ হিন্দুধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আসলে বিষয়টি আদৌ সত্য নয়। সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেছিলেন খাজনা আদায়ে সুবিধা ও সুষ্ঠুতার জন্য। সম্রাটের আদেশে তৎকালীন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহ উল্লাহ সিরাজি সৌর সন শকাব্দ ও আরবি হিজরি এ দুটি সনের মিশ্রণে নতুন বাংলা সন বিনির্মাণ করেছিলেন। এখন আমাদের সামনে প্রশ্ন আসতে পারে খাজনা আদায়ের জন্য নতুন একটি সনের প্রয়োজন কেন অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে খাজনা আদায় করা হতো আরবি হিজরি সন অনুযায়ী অথচ ফসল উৎপাদিত হতো সৌর সন অনুযায়ী। আমরা সবাই জানি, হিজরি সন হলো চাঁদের হিসাবে। হিজরি চান্দ্র সন হওয়ায় এ সনের দিনের সংখ্যা ৩৫৪/৩৫৫। অন্যদিকে সে সময়ের শকাব্দ নামে যে সৌর সন ছিল, দিনের হিসাবে তা ৩৬৫। অর্থাৎ চান্দ্র সন সৌর সনের চেয়ে ১০/১১ দিন কম। এজন্যই আমরা দেখি প্রতি বছর রোজা কিংবা ঈদ নির্ধারিত দিনের চেয়ে ১০/১১ দিন কমে আসে।
লেখক: আফছানা রহমান, বার্তা সম্পাদক সিএনএন বিডি ২৪.কম।