প্রধান দুই দলই মনোনয়ন দিয়েছে রাজনীতিতে প্রায় উদ্বাস্তু দুই প্রার্থী। একজন ব্যবসায়ী পুত্র, অন্যজন ব্যবসায়ী। একজন যোগ্য রাজনীতিবিদকে মনোনয়ন দানের অক্ষমতা বা ব্যর্থতা আরেকবার প্রমাণ করল- রাজনীতির লাটাই এখন রাজনীতিবিদদের দখলে নেই।
বর্তমান সরকার আইন সংশোধণ করে স্থানীয় নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর ভালো-মন্দ নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এর ফলে প্রার্থীর গুরুত্ব কমে গেছে। যে কেউ নৌকা বা ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে মাতিয়ে দিতে পারে।
এই সুযোগটা ইতিবাচক ভাবে কাজে লাগানো যেত, দলের পরীক্ষিত কর্মীদের এর ফলে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল। কিন্তু দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল কেউই এ পথে হাঁটেনি। রাজনীতি এখন এক ব্যয়বহুল বাণিজ্য। রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের আধিপত্য রীতিমতো আগ্রাসনের পর্যায়ে পৌঁছেছে।
রাজনীতিকে কালো টাকা, পেশিশক্তি আর লুটেরাদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে- এসব এখন কেতাবের কথা। বাস্তবে কোনো প্রধান রাজনৈতিক দল এর চর্চাতো করেই না, বিশ্বাসও করেনা। দেশে যেমন ধনী দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ছে তেমনি বৈষম্য বাড়ছে রাজনীতিবিদ আর টাকাওয়ালাদের।
রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মীরা এখন সংগঠনের জন্য কাজ করবে, বিরোধী দলে থাকলে আন্দোলন করবে, জেল খাটবে, হুলিয়া মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াবে- নির্বাচন এলে তার সামনে আবির্ভূত হবেন এক নাযেল হওয়া দেবদূত। দেবদূত টাকা ওড়াবেন, নতুন চামচা নেবেন, কর্মীরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখবেন।
আর যে দল ক্ষমতায় আছে সেই দলের কর্মীরা কিছু কর্মসূচি করবে, বিশেষ দিবসের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেবে, আর হতবাক হয়ে নতুন নেতার কাণ্ড দেখবেন। ‘নির্বাচন’ বিষয়টি এখন রাজনীতিবিদদের বিষয় নয়, এটা ‘ব্যবসা’ বাণিজ্যের বিষয়।
দুর্ভাগ্য হলো, আওয়ামী লীগও ব্যবসায়ী লীগের পথেই দ্রুত ধাবমান হচ্ছে। বিগত নির্বাচনে যখন আনিসুল হককে ঢাকা উত্তরের মেয়র পদে দেওয়া হলো, তখন এভাবে হৃদয় ভাঙ্গেনি কারও। কারণ আনিসুল হকের পরিচয় শুধু ব্যবসাগন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
তিনি শিল্পানুরাগী ছিলেন, জনপ্রিয় উপস্থাপক ছিলেন, রাজনীতির বিষয়েও তাঁকে উপেক্ষা করা যেতো না। কিন্তু এবার যখন গার্মেন্টর্স ব্যবসায়ী আতিকুল ইসলামের নাম এলো তখন মনেই হলো- হায়রে আওয়ামী লীগ! আতিকুল আলম যখন তাঁর মনোনয়ন প্রাপ্তির আকাঙক্ষা পত্রটি দলীয় কার্যালয়ে জমা দিতে গিয়েছিলেন, তখন তাঁর চারপাশে কারা ছিলেন?
ছিলেন কিছু ব্যবসায়ী। বিশেষত সালমান এফ রহমানকে সবার চোখে পড়েছে। মো. আতিকুল ইসলামের চারপাশে কোনো রাজনীতিবিদ ছিলেন না। ধানমণ্ডির তিন নম্বর সড়কে মনোনয়ন প্রত্যাশা ফরম জমা দেয়ার দৃশ্য দেখছিলেন কর্মীরা। তাঁরা আতিকুল ইসলামকে চিনতেই পারল না।
শেষ পর্যন্ত যদি নির্বাচন হয়, তাহলে ‘মেয়র’ এর চেয়ারে বসবেন একজন ব্যবসায়ী। ওই চেয়ারটি কি তাহলে ব্যবসায়ীদের জন্য নিদিষ্ট হয়ে গেলো? এটা কি রাজনীতির জন্য কোনো শুভ লক্ষণ?
জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত কোটা আছে। ঢাকা উত্তরের মেয়র পদ কি সেরকম ব্যবসায়ীদের জন্য সংরক্ষিত?
দুনিয়াজুড়ে পানামা পেপারস কেলেঙ্কারীতে জড়িতরা যখন ক্ষমতা এবং রাজনীতি থেকে বিতাড়িত হচ্ছে তখন বিএনপি এমন একজনকে মেয়র প্রার্থী করলো যার পুরো পরিবার অর্থপাচার সহ বিভিন্ন লজ্জাজনক কাজে জড়িত’ এমন কথা আক্ষেপের সুরে বললেন ঢাকা উত্তরের মনোনয়ন প্রত্যাশী বিএনপির বিশেষ সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন। তিনি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে একে রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা বলে অভিহিত করেছেন।
পানামা পেপারস থেকে প্যারাডাইস পেপারস সব জায়গায় নাম আছে তাবিথ আউয়াল সহ তার পুরো পরিবারের। এতো অপকর্ম, এতো অপরাধ থাকার পরেও বিএনপির কোন ক্লিন ইমেজের নেতাকে মেয়র প্রার্থী না করার পেছনে মূলত এই আর্থই মূল কারণ হিসেবে দেখছে বিএনপির অনেক শীর্ষ স্থানীয় নেতা। দলের অনেক ত্যাগী নেতারা পদবঞ্চিত হয়ে চিরতরে রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ছে।
লেখক: আফছানা রহমান ,বার্তা সম্পাদক সিএনএন বিডি ডটটিভি।