প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা মোতাবেক, এ বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। সংবিধানের আজগুবি সংশোধনী অনুযায়ী, সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচন। সে অনুযায়ী, এই সংসদের মেয়াদ রয়েছে জানুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত। তিন মাস আগে নির্বাচন হলে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে হতে হবে। সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী যথার্থভাবেই সুবিধাজনক ‘ব্যাসার্ধ’ নিয়েছেন। ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয় অর্জনে আওয়ামী লীগ ষোলোআনা কৃতিত্ব দাবি করে থাকে। সমালোচকরা বলে থাকেন, জনগণের কৃতিত্বের কাছে তাদের ‘ষোলোআনাই মিছে’ প্রমাণিত হতে পারে। তা অন্য কথা। আমরা বলছিলাম, ভোটের কথা। বিধি অনুযায়ী প্রতিটি নির্বাচনের একটি তফসিল বা সময়সূচি থাকে। এটা ঘোষিত হলেই কেবল নির্বাচনী প্রচার অভিযান শুরু হতে পারে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে আমাদের প্রধানমন্ত্রী অনেক আগেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারাভিযান শুরু করে দিয়েছেন। তাও সরকারি আনুষ্ঠানিকতার সাথে। নির্বাচনী জনসভার আগে অনেকগুলি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী জনসভা শুরু করার বিষয়ে নাগরিক সাধারণ বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। গণমাধ্যমের লোকজনের কাছে জিজ্ঞাসা করে, সমসাময়িক পৃথিবীতে এত আগে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হওয়ার উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। সমালোচকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী হয়তো আস্থার সঙ্কটে ভুগছেন। প্রকাশিত কর্মসূচি অনুযায়ী তিনি আগামী এক বছরে বিভাগ, জেলা, নগর, মহানগর চষে বেড়াবেন। দেশের এক ইঞ্চি জমিও তিনি হয়তো অকর্ষিত রাখবেন না। একই সাথে সরকারি কর্মসূচি এবং নির্বাচনী জনসভা করা যায় কিনা- তাও বিবেচ্য বিষয়। নির্বাচন ব্যবস্থা পরিচালিত হয় Representation of Peoples Order-RPO দিয়ে। নির্বাচনী জনসভা RPO বিধি-বিধান, নির্বাচনী আচরণবিধি এবং প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি বিরোধী। নির্বাচন কমিশন প্রায়ই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড অর্থাৎ সবার জন্য সমান সুযোগ সুবিধার কথা বলে থাকে। সিভিল সোসাইটি এর ব্যতিক্রম হলে বক্তৃতা বিবৃতি দেয়। নির্বাচন কমিশন অবশ্যই দেখছেন যে, প্রধানমন্ত্রী সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাসংশ্লিষ্ট মর্যাদা ব্যবহার করে সরকারি অর্থেই দলীয় প্রচারণা চালাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, তিনি ভোটের পাশাপাশি উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করছেন। নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। দেশের কোনো আইন এ কার্যক্রম সমর্থন করে না। অবশ্য দেশে আইনের শাসন আছে বলে মনে হয় না। এটাও অনেক সময়ে বলা হয়, Some are more equal, than the equals। একক কর্তৃত্বের রাষ্ট্রে ব্যক্তিই রাষ্ট্র, ব্যক্তিই আইন। যেমন- ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুই বলতেন, ‘আমিই রাষ্ট্র, আমিই আইন।’ বর্তমান বিশ্বের একক পরাক্রমের অধিকারী ডোনাল্ড ট্রাম্পও কার্যত ‘রাষ্ট্রপতির আদেশ’ দিয়ে রাষ্ট্র চালাচ্ছেন; আইন দিয়ে নয়। অথচ তারা গণতন্ত্রের কথা বলে থাকেন। তত্ত্ব ও বাস্তবে অনেক কিছুতে, অনেক ফারাক। নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত টুঁ শব্দটি করেনি। তবে এখনো সময় আছে। আমরা নির্বাচন কমিশনের প্রতিশ্রুত কর্তৃত্বে আস্থা রাখতে চাই।
সংবিধান অনুযায়ী, বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতির’ অঙ্গীকার রয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশের ১১৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ পদ্ধতিগতভাবে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে। এই পদ্ধতি অনুযায়ী সংসদের আস্থাভাজন সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করে থাকে। সাধারণত সংখ্যালঘিষ্ঠ দল বিরোধী দলে অবস্থান করে। আইন ও ঐতিহ্য অনুযায়ী, বিরোধী দলকে সরকারের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশে এখন যে ব্যবস্থা বিরাজ করছে, তা নির্ণয় করতে রাষ্ট্র্রবিজ্ঞানীদের গলদঘর্ম হতে হবে। ব্রিটেনে বিরোধী দলকে রাজা বা রানীর নামে বলা হয়, His or Her Majesty's Opposition। বাংলাদেশে অবশ্য এরশাদ আমলে ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলের কথা শোনা গিয়েছিল। এখন ‘গৃহপালিত’ শব্দটির ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে গৃহপালিত বিরোধী দলের লোকেরা সরকারে আছে। তারা গাছেরটাও খাচ্ছেন, তলারটাও কুড়াচ্ছেন। চরম বিতর্কিত নির্বাচনের চার বছরপূর্তি উপলক্ষে গৃহপালিত বিরোধী দলের উপকারিতা সম্পর্কে সংসদে তারা যে বয়ান দিয়েছেন, তাতে ‘গাধা ভি হাসব’। সবাই জানে এবং বোঝে, প্রকৃত বিরোধী দল ‘বোগাস সংসদে’ নেই বরং আন্দোলনের ময়দানে আছে। তুলনামূলক আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট, সমতা ও ন্যায়বিচার থেকে একপক্ষ বঞ্চিত হচ্ছে; অপরপক্ষ নিয়ম-কানুন রীতিনীতি, ভদ্রতা, ভব্যতা -কোনো কিছুরই তোয়াক্কা না করে বেপরোয়াভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিএনপির জয়লাভের মতো এবার যাতে আগাম উৎসাহের ঘটনা না ঘটে সেজন্যও ক্ষমতাসীন দল সতর্ক রয়েছে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। মূলত কৌশলগতভাবে ওই বিরাট বিজয় বিএনপির জন্য এক ধরনের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তখন থেকেই শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য ন্যায়নীতি ও গণতন্ত্রকে বিসর্জন দিয়ে নির্বাচনকে অকার্যকর করে তুলছে। এ লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিধান সংবিধান থেকে বিলোপ করা হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচন করে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। ১৫৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় তখন ক্ষমতাসীন দল বহির্বিশ্বে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয়। এবার তারা সে বদনাম ঘুচাতে চায়। কৌশলটি হচ্ছে- বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে হবে এবং ‘আনন্দের সাথে’ পরাজয় বরণ করতে হবে।
লেখক : বার্তা সম্পাদক সিএনএন বিডি.টিভি।